
ছবি: সংগৃহীত
প্রতিদিনের নানা কাজের মধ্যে যেভাবে আমরা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করি, তার মধ্যে অনেক সময়ই কোনো অচেনা নম্বর থেকে আসা ছবি বা মেসেজ আমাদের কৌতুহল জাগায়। হোয়াটসঅ্যাপে একটি ছবির মাধ্যমে যদি কেউ জানতে চায়, “এনাকে চেনেন?” কিংবা কোনো সুন্দরী ব্যক্তির ছবি পাঠানো হয়, অনেকেই এভাবে ছবিটি ক্লিক করে বসেন। তবে এই একমাত্র ক্লিকেই ঘটতে পারে সবচেয়ে বড় বিপদ। অনেকের মনে হতে পারে, এটি নিছক একটি ছবি, কিন্তু আসলে এর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে ভয়াবহ সাইবার আক্রমণ, যা আপনাকে সর্বস্ব হারাতে পারে।
স্টেগনোগ্রাফি ফাঁদ: কী তা?
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করেছেন, হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার সময় একে অপরকে একেবারে চিন্তা না করেই অজানা নম্বর থেকে আসা ছবি বা মেসেজ না খোলার জন্য। এর মূল কারণ হচ্ছে, একটি বিশেষ সাইবার প্রযুক্তি—স্টেগনোগ্রাফি এলএসবি (Least Significant Bit) প্রযুক্তি। স্টেগনোগ্রাফি শব্দটি মূলত গ্রীক ভাষা থেকে এসেছে, যার বাংলা অর্থ ‘গোপন লেখা’। প্রযুক্তির দুনিয়ায়, এই কৌশলটি ব্যবহার করে সাইবার অপরাধীরা একটি ছবির মধ্যে গোপন ম্যালওয়্যার বা কোড এম্বেড করে দেয়। এই কোডটি ফোনের সিস্টেমে ঢুকে গিয়ে আপনার ফোনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, যা আপনার ব্যক্তিগত এবং আর্থিক নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
স্টেগনোগ্রাফি সিস্টেমে ম্যালওয়্যার কোনো সরাসরি ভাইরাস বা স্প্যাম ফাইলের মতো আচরণ না করে, বরং ছবির ফাইলের মধ্যে গোপনে এক ধরনের স্ক্রিপ্ট এম্বেড করে। ম্যালওয়্যার এমনভাবে লুকানো থাকে যে, এটি সাধারণ ব্যবহারের মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্ট বা সফটওয়্যার ছাড়া এই কোডটি দেখা বা শনাক্ত করা খুবই কঠিন।
কীভাবে কাজ করে স্টেগনোগ্রাফি?
২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন ‘জিফ’ ফাইলের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। হ্যাকাররা যখন একটি ছবি বা ফাইল পাঠান, তখন সেই ছবিতে লুকিয়ে থাকে এমন একটি কোড যা ফোনের ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজ করতে শুরু করে। ছবিটি যখন ডাউনলোড করা হয়, তখন ওই কোডটি ফোনের সিকিউরিটি সিস্টেমকে বাইপাস করে এবং ফোনের ডেটা সংগ্রহ করতে শুরু করে। সাধারণত, ছবি বা ছবির ফাইলের তিনটি মূল রঙ—লাল, সবুজ এবং নীল—এ ব্যবহারকারীর ফোনের অতি ক্ষুদ্র অংশে এই ম্যালওয়্যার বা কোডটি লুকানো থাকে। এই কোডটি আলফা চ্যানেলে থাকে, যা খুবই সূক্ষ্ম এবং শনাক্ত করা কঠিন।
বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
এতসব সতর্কতা সত্ত্বেও, অনেকেই দয়া বা কৌতুহলের কারণে অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ছবিটি ক্লিক করেন। তবে সাইবার বিশেষজ্ঞরা এর জন্য বেশ কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সতর্কতা জারি করেছেন, যা আপনাকে এই ধরনের ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে পারে:
অজানা নম্বরের মেসেজ এড়িয়ে চলুন: অপরিচিত নম্বর থেকে আসা যেকোনো ছবি বা ফাইল ডাউনলোড করবেন না। এটি খোলার আগে, মেসেজটির উৎস যাচাই করতে হবে।
ফোনের সফটওয়্যার আপডেট রাখুন: নিয়মিত ফোনের সফটওয়্যার আপডেট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে সাইবার আক্রমণের বিরুদ্ধে নতুন সুরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত থাকে।
হোয়াটসঅ্যাপে ‘সাইলেন্ট আননোন কলার্স’ ফিচার চালু করুন: এটি অপরিচিত কলগুলোকে সাইলেন্টে রাখে, যা আপনার ফোনে বারবার বিরক্তিকর কল আসা কমাবে।
OTP বা পাসওয়ার্ড শেয়ার করবেন না: অজানা নম্বর থেকে আসা কোনো মেসেজের মাধ্যমে কখনোই আপনার OTP বা পাসওয়ার্ড শেয়ার করবেন না। সাইবার অপরাধীরা এই পদ্ধতিতে আপনার ব্যাংকিং বা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতে পারে।
কিউআর কোড স্ক্যান থেকে বিরত থাকুন: অপরিচিত ব্যক্তি থেকে কিউআর কোড পাঠানো হলে কখনোই তা স্ক্যান করবেন না। এটি আপনার ফোনের নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলতে পারে।
কৌতুহল দমন করুন: কৌতুহল কখনোই আপনার নিরাপত্তার চেয়ে বড় না হওয়া উচিত। কোন মেসেজ বা ছবি আকর্ষণীয় মনে হলে, একে দ্রুত খুলে দেখার আগে কিছুক্ষণ ভাবুন।
সাইবার নিরাপত্তার জন্য নতুন প্রযুক্তি
বর্তমানে, সাইবার বিশেষজ্ঞরা স্টেগনোগ্রাফি ফাঁদের বিরুদ্ধে নতুন প্রযুক্তি তৈরি করার কাজ করছেন। এআই (Artificial Intelligence) এবং মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে দ্রুত এই ধরনের ম্যালওয়্যার শনাক্ত করার উপায় তৈরি হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে, ফোনের অ্যান্টিভাইরাস এবং নিরাপত্তা সিস্টেমগুলো উন্নত হয়ে যাচ্ছে, যা ব্যবহারকারীদের আরও বেশি সুরক্ষা প্রদান করবে।
সতর্কতা এবং সচেতনতা
এটি পরিষ্কার যে, বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ায় হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্য কোনো যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সময় সতর্কতা অপরিহার্য। অপরিচিত নম্বর থেকে আসা মেসেজ বা ছবি কোনভাবেই যাচাই না করে খোলা উচিত নয়। প্রযুক্তির এই যুগে যখন তথ্য সংগ্রহের ফাঁদ প্রায় প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে থাকে, তখন আমাদের সচেতনতা এবং সাবধানতা বজায় রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ