
ছবি: সংগৃহীত
তুরস্কে ইস্তাম্বুলের মেয়র একরাম ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া তীব্র বিক্ষোভ শেষ হয়েছে। টানা সাত দিন ধরে চলা এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি।
আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার
গত ১৯ মার্চ, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইমামোগলুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে ইস্তাম্বুলসহ দেশজুড়ে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বিরোধী দল সিএইচপি আন্দোলনের ডাক দিয়ে ইস্তাম্বুল সিটি করপোরেশন ভবনের সামনে লাগাতার বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তুরস্কের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা
বিরোধী দলীয় নেতা ওজগুল ওজেল স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি জানান, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করেছি, এখন কৌশল পরিবর্তন করে নতুনভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে যাব। আমরা ইফতার ও ঈদের জমায়েতের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করব।’ তবে তিনি হুঁশিয়ারি দেন, সরকার যদি দমননীতি চালিয়ে যায়, তাহলে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকবে বিরোধী দল।
এরদোয়ানের কৌশলী পদক্ষেপ
অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই আন্দোলনকে সফলভাবে মোকাবিলা করে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আবারও তার রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুরু থেকেই তার প্রশাসন ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। প্রথমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও, পরবর্তী সময়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেয়। ১,১৩৩ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বেশ কয়েকটি নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্যদেরও আটক করা হয়।
এরদোয়ানের প্রশাসন বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ না দিয়ে বিরোধী দলীয় একজনকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বিরোধী দল কিছুটা সন্তুষ্ট হয় এবং আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়।
বিক্ষোভ কেন গণআন্দোলনে রূপ নেয়নি?
বিক্ষোভ ব্যাপক আলোড়ন তুললেও এটি জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে রূপ নেয়নি। ইমামোগলুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়, বরং দলীয় বিভক্তির কারণেও তিনি সমর্থন হারাচ্ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সরকারি তহবিলের ৫৫৬ বিলিয়ন লিরা তছরুপের অভিযোগ রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া তথ্য অনুযায়ী, ইস্তাম্বুল সিটি করপোরেশন থেকে ৩২২ মিলিয়ন লিরার একটি টেন্ডারের অর্থ ইমামোগলুর ব্যক্তিগত কোম্পানির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছে। বিরোধী দলও এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করতে পারেনি।
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক প্রভাব
আন্দোলন চলাকালে তুরস্কের মুদ্রার মান ৬ শতাংশ কমে যায়, যা দেশটির অর্থনীতির ওপর সাময়িক প্রভাব ফেলে। তবে সরকারের কৌশলী পদক্ষেপের ফলে বাজার আবার স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে আন্দোলনকে এরদোয়ানের সরকারের পতনের সম্ভাব্য সংকেত হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই সরকারের অনুকূলে ছিল।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক নতুন দিক পাচ্ছে। তুরস্কের নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরদোয়ানকে ‘যোগ্য নেতা’ হিসেবে প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি, সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব প্রতিরোধে তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে।
সামনের চ্যালেঞ্জ
এরদোয়ানের সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা। সরকারের কৌশলগত সাফল্য তাকে আগাম নির্বাচন ডাকার সিদ্ধান্তে উৎসাহিত করতে পারে, যাতে তিনি আবারও প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
তুরস্কের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে আলোড়ন তুললেও এটি সরকারের পতনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। বরং কৌশলী ও সমঝোতামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার অবস্থান আরও দৃঢ় করেছেন। আপাতত দেশটি স্থিতিশীলতার পথে এগোলেও ভবিষ্যতে বিরোধী দল নতুন কৌশলে আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ