
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ইতিহাসে নজিরবিহীন আর্থিক কাটছাঁটের প্রস্তাবনা উঠে এসেছে একটি সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ নথিতে। প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০২৬ অর্থবছরের জন্য দেশটির বৈদেশিক নীতি ও কূটনৈতিক কার্যক্রমের বাজেট প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা হতে পারে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে তা বৈশ্বিক কূটনীতি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে এক বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাজেট কাটছাঁটের প্রস্তাব: কী থাকছে?
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যেমন এএফপি, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও পাঞ্চবোল নিউজ জানিয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বাজেট ২০২৫ সালের তুলনায় ২৬ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে ২৮.৪ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জাতিসংঘ, ন্যাটো, ইউনিসেফ, ওইসিডি-এর মতো সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল কার্যত বাতিল করে দেওয়া হবে বলে উল্লেখ রয়েছে প্রস্তাবে।
বিশেষ করে ফুলব্রাইট প্রোগ্রামসহ আন্তর্জাতিক শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রমের বাজেট কমিয়ে আনার সুপারিশ রয়েছে। ট্রপিক্যাল রোগ প্রতিরোধ, শিশুদের টিকা কার্যক্রম, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নমূলক প্রকল্প—এসব গুরুত্বপূর্ণ মানবিক উদ্যোগও বাজেট ছাঁটাইয়ের শিকার হতে পারে।
দূতাবাস ও কনস্যুলেট বন্ধের সুপারিশ
এই প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী ১০টি দূতাবাস ও ১৭টি কনস্যুলেট বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে। যেসব দেশে কূটনৈতিক মিশন বন্ধের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে:
দূতাবাস: ইরিত্রিয়া, লুক্সেমবার্গ, দক্ষিণ সুদান, মাল্টা
কনস্যুলেট: ফ্রান্সে ৫টি, জার্মানিতে ২টি, স্কটল্যান্ড, ইতালি
কানাডা: মন্ট্রিয়াল ও হ্যালিফ্যাক্সে ছোট পরিসরে সীমিত কূটনীতির প্রস্তাব
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আন্তর্জাতিক মিশন যেমন ওইসিডি ও ইউনিসেফের অফিস এখন সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে একীভূত করে ফেলা হবে। এতে করে আলাদা কূটনৈতিক ব্যয়ের প্রয়োজন পড়বে না বলে যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
ইউএসএআইডি বিলুপ্তির প্রস্তাব
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনে একীভূত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সংস্থাটি বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়ন কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে এই প্রস্তাব অনুযায়ী ইউএসএআইডির স্বাধীনতা বাতিল করে তার কার্যক্রম সীমিত করার লক্ষ্য রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউএসএআইডিকে বন্ধ করার বিষয়টি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও টেক টাইকুন ইলন মাস্ক উভয়ের এজেন্ডায় রয়েছে, যা প্রস্তাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
কূটনৈতিক মহলে উদ্বেগ
এই প্রস্তাব ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। মার্কিন ফরেন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন প্রস্তাবটিকে ‘বেপরোয়া ও বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে, রাশিয়ায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফল মন্তব্য করেছেন,
"এই প্রস্তাব চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য এক বিশাল উপহার।"
এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও কূটনৈতিক সক্ষমতা হ্রাস পাবে, এবং আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আইনপ্রণেতাদের সামনে চ্যালেঞ্জ
যদিও হোয়াইট হাউস থেকে সরকারি দপ্তরগুলোকে এই সপ্তাহের মধ্যেই বাজেট ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা জমা দিতে বলা হয়েছে, কিন্তু প্রস্তাবটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে। কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের প্রভাব থাকলেও, বাজেট সংক্রান্ত যেকোনো প্রস্তাব পাসে ডেমোক্রেটদের সমর্থন প্রয়োজন।
ফলে এ বাজেট কাটছাঁট নিয়ে আগামী সপ্তাহগুলোতে কংগ্রেসে দীর্ঘ বিতর্ক ও রাজনৈতিক আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান
এএফপির খবরে বলা হয়েছে, বাজেট প্রস্তাবের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। ফলে এই প্রস্তাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সায় দিয়েছেন কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে চূড়ান্ত বাজেট কংগ্রেসে পাঠানোর আগে তাঁর স্বাক্ষর প্রয়োজন হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই উদ্যোগ শুধুমাত্র ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে নয়, বরং বৈশ্বিক মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব ভূমিকাকে সীমিত করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ।
এই প্রস্তাব যদি বাস্তবায়ন হয়, তবে তা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতায় নয়, বরং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির ভবিষ্যৎ রূপরেখা কী হবে, তা অনেকটাই নির্ধারিত হবে এই বাজেট আলোচনা এবং কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ