
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব রাজনীতির উত্তাল সময়ে এক চমকপ্রদ কূটনৈতিক বার্তা দিল চীন। ২০২৫ সালের শুরু থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র চার মাসে প্রায় ৮৫ হাজার ভারতীয় নাগরিককে ভিসা প্রদান করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ, যা এক কথায় নজিরবিহীন এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এসেছে, যখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুল্ক ও বাণিজ্য নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রশাসন এমন এক পরিস্থিতিতে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করে বন্ধুত্বের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীনের রাষ্ট্রদূতের খোলা বার্তা:
ভারতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সু ফেইহং তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে (পূর্বতন টুইটার) লিখেছেন, “আমরা চাই আরও বেশি ভারতীয় বন্ধু চীনে আসুন। চীনের প্রাণবন্ত সংস্কৃতি, নিরাপদ পরিবেশ ও আধুনিক নগরায়নের সঙ্গে পরিচিত হোন। চীন ভারতীয়দের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।”
এই বার্তা স্পষ্টভাবেই ইঙ্গিত দিচ্ছে—বহুপাক্ষিক বিরোধের মাঝে চীন ভারত-চীন সম্পর্ককে নতুন করে বিনির্মাণের পথে নিয়ে যেতে চাইছে।
ভারতীয়দের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া আরও সহজ:
চীনা প্রশাসন ভারতীয় নাগরিকদের জন্য যেসব বিশেষ সুবিধা দিয়েছে, তা হলো:
ভিসা আবেদনের জন্য অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের প্রয়োজন নেই। সরাসরি দূতাবাস বা কনসুলেটে গিয়ে আবেদন করা যাচ্ছে।
স্বল্পমেয়াদি সফরের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক তথ্য দিতে হচ্ছে না, ফলে প্রক্রিয়া আরও সহজ ও দ্রুত হয়েছে।
ভিসা ফি কমানো হয়েছে, যা শিক্ষার্থী ও পর্যটকদের জন্য বাড়তি সুবিধা।
ভিসা প্রসেসিংয়ের সময় অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়েছে, বিশেষ করে ব্যবসা ও পর্যটন ভিসায়।
এই সিদ্ধান্তগুলো ভারতের সঙ্গে জনসাধারণের বিনিময় ও সম্পর্ক উন্নয়নে এক বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পর্যটন ও সংস্কৃতির সংযোগ:
ভারতীয় পর্যটকদের চীনে আকৃষ্ট করতে বিশেষ পর্যটন প্যাকেজ চালু করেছে চীনা কনসুলেটগুলো। দেশটির ঐতিহ্যবাহী শহর, উৎসব ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরে আয়োজিত হচ্ছে ‘চায়না ডিসকভার’ প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন, যাতে শিক্ষার্থী, পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা অংশ নিতে পারেন।
সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যেও কূটনৈতিক তৎপরতা:
ভারত-চীন সীমান্ত বিশেষ করে লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশে ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (LAC)’ ঘিরে এখনো কিছু কিছু জায়গায় সামরিক স্ট্যান্ডঅফ থাকলেও, সামগ্রিকভাবে উত্তেজনা তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিসা ইস্যুতে চীনের এমন ইতিবাচক অবস্থান সম্ভবত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বরফ গলানোর প্রচেষ্টা। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষ-পরবর্তী অবনমিত সম্পর্কের প্রেক্ষিতে এই উদারতা কূটনৈতিকভাবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
চীনের অর্থনৈতিক যুদ্ধ এবং ভারতের ভূমিকা:
চীন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক অভূতপূর্ব শুল্ক-সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য নীতির আওতায় চীনা পণ্যের উপর সর্বোচ্চ ১৪৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
এর জবাবে চীনও পাল্টা শুল্কের ব্যবস্থা নিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতকে কৌশলগতভাবে কাছে টানার চেষ্টা করছে বেইজিং। চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র ইউ জিং বলেছেন, “চীন-ভারত অর্থনৈতিক সম্পর্ক পরস্পরের পরিপূরক। শুল্ক-সংঘাতের বিশ্বে দুই দেশ সহযোগিতা করে টিকে থাকতে পারে।”
শিক্ষা বিনিময়ে পুনর্জাগরণ:
ভিসা সহজীকরণের ফলে সবচেয়ে উপকৃত হবে চীনে অধ্যয়নরত হাজার হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী, বিশেষত যারা মেডিকেল ডিগ্রির কোর্সে ভর্তি ছিলেন এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটেছিল।
চীন বর্তমানে শিক্ষার্থী ভিসাও দ্রুত ইস্যু করছে এবং দীর্ঘসূত্রতা দূর করে ক্যাম্পাসে ফেরার সুযোগ করে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য:
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. রোহিত কুমার বলেন, “চীন এই মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের পথে কৌশলগতভাবে নরম ভূমিকা নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ভারতকে পাশে পাওয়াটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
চীনের তরফ থেকে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ভিসা নীতিতে এমন শিথিলতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ বার্তা কেবল ভ্রমণ বা ব্যবসার সুযোগ নয়, বরং এক নতুন কূটনৈতিক সমঝোতার ইঙ্গিত বহন করছে। সীমান্তে উত্তেজনার আবহ সত্ত্বেও বেইজিংয়ের এই বার্তা ভারতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সংকেত।
বিশ্বশক্তির হিসাব-নিকাশের ফাঁকে চীন-ভারত সম্পর্ক আবারও একটি নতুন পর্বে প্রবেশ করতে চলেছে কিনা—সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ