
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব বাণিজ্যে উত্তেজনার পারদ যেন আরও চড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ এখন নতুন এক উত্তপ্ত অধ্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিশোধের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র এবার চীনা পণ্যের ওপর শুল্কহার বাড়িয়ে ২৪৫ শতাংশে উন্নীত করেছে, যা এযাবৎ সর্বোচ্চ।
মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, এই নতুন শুল্কহার মূলত চীনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের পাল্টা জবাব। সেখানে বলা হয়, “প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের ফলে চীনা পণ্য এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের মুখোমুখি হবে।”
বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এ শুল্কযুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। কখনও তা কিছুটা শিথিল হলেও সাম্প্রতিক সময়ের পদক্ষেপগুলোয় বোঝা যাচ্ছে, নতুন করে এই যুদ্ধ আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
ক্রমাগত বাড়ছে শুল্ক, বন্ধ নেই পাল্টা জবাব
২০২৪ সালের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে। এরপর এপ্রিলের ২ তারিখে নতুন করে আরও ৩৪ শতাংশ শুল্ক বাড়ানো হয়। চীনও এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় নিজস্ব শুল্কহার বৃদ্ধি করে।
এখানেই থেমে থাকেননি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি সরাসরি ঘোষণা দেন, চীনের পাল্টা পদক্ষেপের জবাবে আরও ৫০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানো হবে। এতে মোট শুল্ক দাঁড়ায় ৮৪ শতাংশ। পূর্বের ২০ শতাংশসহ সেই হার দাঁড়ায় ১০৪ শতাংশে।
এরপর আরও একধাপে শুল্ক বাড়িয়ে সেটিকে করা হয় ১২৫ শতাংশ। এরপর ১০ এপ্রিল আবারও বাড়ানো হয় শুল্কহার, যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৪৫ শতাংশে।
কিন্তু চীনও রণে ভঙ্গ দেয়নি। ১১ এপ্রিল, যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৫ শতাংশ শুল্কের জবাবে বেইজিং ঘোষণা দেয়, তারা মার্কিন পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করবে। এই পাল্টা ব্যবস্থাই ট্রাম্প প্রশাসনের পরবর্তী সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।
সর্বোচ্চ শুল্কহার—২৪৫ শতাংশ
সবশেষে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর শুল্কহার আরও ১০০ শতাংশ বাড়িয়ে, পূর্ববর্তী ১৪৫ শতাংশের সঙ্গে মিলিয়ে একে ২৪৫ শতাংশে উন্নীত করে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। শুল্কনীতি তার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।”
৭৫টি দেশের জন্য স্থগিত শুল্ক, কিন্তু ব্যতিক্রম চীন
উল্লেখযোগ্যভাবে, হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ৭৫টিরও বেশি দেশের ওপর যে নতুন আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে।
তবে চীন এই সুবিধার আওতায় আসেনি। কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের জবাবে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যা ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে ‘প্রতিশোধমূলক’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে। ফলে চীন এখন এই স্থগিতাদেশের আওতার বাইরে রয়েছে এবং সর্বোচ্চ শুল্কহার তাদের ওপরই কার্যকর হয়েছে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে কি বলছে এই পদক্ষেপ?
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার এই চলমান শুল্কযুদ্ধ শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। এর প্রভাব পড়ছে গোটা বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায়।
বিশেষ করে প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিকস, ইস্পাত, গাড়ি, সোলার প্যানেল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্রাংশসহ বহু চীনা পণ্যের ওপর এই উচ্চমাত্রার শুল্ক আরোপ বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে বড় ধাক্কা দিতে পারে।
আরও আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে, যদি এই উত্তেজনা এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, সরবরাহ সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ভারসাম্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
চীনের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
চীন এই নতুন ২৪৫ শতাংশ শুল্কের জবাবে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে, তা নিয়ে বৈশ্বিক কূটনৈতিক অঙ্গনে জোর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। চীন অতীতে যেমন জবাব দিয়েছে, এবারও পাল্টা পদক্ষেপ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে বেইজিং এখন কৌশলী হতে পারে বলেই অনেকে মনে করছেন। কারণ, একই সঙ্গে তারা অন্য বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গেও ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের ফলে তাদের কৌশলগত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতেই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—যেমন মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ঘাটতি। এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই নতুন শুল্কযুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মহলের প্রধান চাওয়া—দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি যেন আলোচনার মাধ্যমে এই বাণিজ্যিক উত্তেজনার সমাধান করে। না হলে, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়, ব্যবসায় এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে—এই বাণিজ্যযুদ্ধে কার হাতে থাকবে শেষ trump card।
বাংলাবার্তা/এমএইচ