
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকার মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপ, জাতিসংঘের হুঁশিয়ারি, মধ্যস্থতাকারী রাষ্ট্রগুলোর আহ্বান—সব কিছু উপেক্ষা করে ইসরাইল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা গাজায় কোনো মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দেবে না। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্ত এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ একযোগে এই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন, যা অঞ্চলটিতে মানবিক সংকটকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
অব্যাহত সহায়তা অবরোধ, ফের হামলা
ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ এক বিবৃতিতে জানান, “ইসরাইলের নীতি স্পষ্ট এবং অনড়। গাজায় কোনো ধরনের মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। হামাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করে জিম্মিদের মুক্ত করার লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত।” কাটজ আরও বলেন, “বর্তমানে গাজায় কোনো সহায়তা প্রবেশের পরিকল্পনা নেই এবং ভবিষ্যতের জন্যও কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি।”
ইসরাইলের এই ঘোষণার মধ্যেই গাজায় বিমান ও স্থল হামলা অব্যাহত রয়েছে। গত ২ মার্চ থেকেই গাজায় ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। ফলে সেখানে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জ্বালানির ঘাটতি চরম আকার ধারণ করেছে।
জাতিসংঘের উদ্বেগ, গাজায় সর্বোচ্চ মানবিক বিপর্যয়
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় কার্যালয় (OCHA) জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর এটাই গাজার সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট। এক বিবৃতিতে তারা জানায়, “গত দেড় মাস ধরে কোনো ত্রাণ সরবরাহ গাজায় পৌঁছায়নি। মানুষ পানি পাচ্ছে না, জ্বালানি শেষ, হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, উত্তর গাজা কার্যত বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। রাস্তায় মরদেহ পড়ে আছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে অগণিত মানুষ। চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে হাজার হাজার আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ভয়াবহ প্রাণহানি, বিভাজিত হিসাব
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫১ হাজার ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। তবে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস বলছে, মৃতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়েছে। তারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে নিহতদেরও এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
নেতানিয়াহুর হুমকি, হামাসের শর্ত
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় মোতায়েন সেনাদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, “হামাস একের পর এক আঘাত খেতে থাকবে। যতক্ষণ না তারা জিম্মিদের মুক্তি দেয়, ততক্ষণ আমরা হামলা আরও জোরদার করব।”
অন্যদিকে হামাস স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তারা বন্দি বিনিময়ে আগ্রহী, তবে তার আগে গাজায় একটি ‘গুরুতর ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির’ নিশ্চয়তা দিতে হবে। হামাসের সিনিয়র নেতা তাহের আল-নুনু বলেন, “আমরা যুদ্ধবিরতি, ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার এবং পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা প্রবেশের নিশ্চয়তার বিনিময়ে সব বন্দিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত।”
নতুন প্রস্তাবনায় যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্য শক্তিগুলোর উদ্যোগ
চলমান অচলাবস্থা নিরসনে মিসর, কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি যৌথ মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিচ্ছে। সম্প্রতি ইসরাইল হামাসকে একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছে, যার আওতায় প্রথম ধাপে ১০ জন জীবিত ইসরাইলি বন্দিকে মুক্তি দেবে হামাস। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের গ্যারান্টিতে দ্বিতীয় ধাপে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে।
এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির রূপরেখা তৈরি করা, যার আওতায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ, সেনা প্রত্যাহার এবং বন্দি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরাইলের এ অবস্থান বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, যুদ্ধের নামে বেসামরিক জনগণকে অনাহারে রেখে হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘসহ অনেক সংস্থা গাজায় অবিলম্বে ত্রাণ প্রবেশের আহ্বান জানালেও, তাতে সাড়া দিচ্ছে না ইসরাইল।
এই পরিস্থিতিতে গাজা উপত্যকা যেন রক্তাক্ত নরকেই রূপ নিয়েছে—যেখানে মানবিক সহায়তা দূরের কথা, জীবন বাঁচানোর ন্যূনতম উপকরণ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। আর আন্তর্জাতিক সমাজের নীরবতা কিংবা সীমিত কার্যকর চাপ ইসরাইলকে অব্যাহতভাবে সহিংসতার পথেই রাখছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ