
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্প্রতি চীনের ওপর যে বিশাল অঙ্কের শুল্ক আরোপের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে, তার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে—‘শুল্কের সংখ্যা নিয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক কৌশলকে’ তারা কোনো গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে বেইজিং জানায়, তারা এই প্রক্রিয়াকে ‘সংখ্যার খেলা’ হিসেবে দেখছে এবং এই ধরনের একতরফা হুমকিকে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে মানতে চায় না।
চীনের প্রতিক্রিয়া এসেছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজ গত মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) প্রকাশিত এক তথ্য বিবরণীতে জানায়, চীনের বিভিন্ন পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের চিন্তা করছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এই শুল্কের মধ্যে রয়েছে ১২৫ শতাংশ ‘পাল্টা শুল্ক’, ২০ শতাংশ ফেন্টানিল সংকট মোকাবেলায় প্রস্তাবিত শুল্ক এবং নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর ৭.৫ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক। হোয়াইট হাউজ এই নতুন শুল্ক কাঠামোর পেছনে যুক্তি দিয়েছে—চীন ‘অন্যায্য বাণিজ্য চর্চা’ করছে এবং এটির মোকাবেলায়ই এই ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান ও চীনের পাল্টা জবাব
এই কঠোর বাণিজ্য অবস্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের কৌশল স্পষ্ট: তারা বিশ্বাস করে যে, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যে চীনের কাছ থেকে ন্যায্য প্রতিদান পায়নি এবং এর ফলে দেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রাম্প দুই সপ্তাহ আগে সব দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দেন, যদিও পরে বেশ কয়েকটি মিত্র দেশের জন্য সেই হার কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু চীনের জন্য সেই শুল্ক কাঠামো বহাল রাখা হয় পুরো কঠোরতার সঙ্গেই।
চীন এই অবস্থানকে একতরফা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলেই বিবেচনা করছে। বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা কেবল সেই আলোচনায় অংশ নেবে যেটি ‘সম্মান ও সমতার’ ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরণ কেবল বাণিজ্য নয়, কূটনৈতিক শালীনতাকেও লঙ্ঘন করছে। চীনা কর্তৃপক্ষ বলছে, এই ধরনের চাপ প্রয়োগমূলক নীতি বাস্তবিক সমস্যার সমাধান তো নয়ই, বরং তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জটিল করে তোলে।
পাল্টা শুল্ক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অভিযোগ ও কৌশলগত পরিবর্তন
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পাল্টা জবাবে চীনও দেশটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমদানিকৃত পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। পাশাপাশি, গত সপ্তাহে বেইজিং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-তে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করে। চীনের ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের একতরফা ও অতিরিক্ত শুল্ক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মূলনীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং এটি বিশ্ব বাণিজ্য কাঠামোর জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর।
চীন আরও জানায়, তারা এই অভিযোগের মাধ্যমে বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করতে চায়, যেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
এই প্রেক্ষাপটে চীন তাদের আলোচনাভিত্তিক কৌশলেও বড় একটি পরিবর্তন এনেছে। দেশটির বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় নিযুক্ত দূত লি চেংগ্যাংকে নতুন বাণিজ্য আলোচক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার নেতৃত্ব দেবেন। তিনি ওয়াং শোউওয়েনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, যিনি দীর্ঘদিন এই দায়িত্বে ছিলেন। এই পরিবর্তন অনেকেই কৌশলগত রদবদল হিসেবে দেখছেন, যেখানে চীন তাদের আলোচনার নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ কূটনীতিক দিয়ে সাজিয়ে নিচ্ছে।
হোয়াইট হাউজের বার্তা: চীন আগে এগিয়ে আসুক
হোয়াইট হাউজের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে একটি কার্যকর বাণিজ্য চুক্তি করতে আগ্রহী, তবে সেই আলোচনায় চীনকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে।” হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের চেয়ে বেশি চীনই এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক দিক থেকে সুবিধার সন্ধানে আছে। তাই চীনকেই আলোচনার মঞ্চে আগে আসতে হবে এবং বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে।”
বৈশ্বিক বাণিজ্যে বিভাজনের শঙ্কা
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই শুল্কযুদ্ধ শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বর্তমানে অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পৃথক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে তারা মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারে। ফলে চীন এক ধরনের বাণিজ্যিক বিচ্ছিন্নতার মুখে পড়ছে বলেও মনে করা হচ্ছে। তবে চীনের পক্ষ থেকে এমনটিও জানানো হয়েছে যে, তারা কোনোভাবেই একতরফা চাপের মুখে মাথা নত করবে না।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই নতুন করে উদ্ভূত শুল্ক উত্তেজনা বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে আরও একটি অস্থিরতার অধ্যায় শুরু করল। যদিও উভয়পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে, কিন্তু তাদের বক্তব্য ও কর্মকৌশল বলছে—দুই পক্ষের অবস্থান এখনও অনেক দূরে। ‘সংখ্যার খেলা’ চালিয়ে একে অপরকে কাবু করতে চাইছে দুই বৃহৎ অর্থনীতি, কিন্তু এই লড়াইয়ের অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বের বাণিজ্য ও কূটনীতির শরীরে। এখন দেখার বিষয়—এই উত্তেজনা একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটে রূপ নেয়, না কি দুই দেশ অবশেষে কূটনৈতিক বোধে ফিরে আসে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ