
ছবি: সংগৃহীত
ইয়েমেনের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ রাস ইসা তেল বন্দরে চালানো মার্কিন বিমান হামলায় অন্তত ৩৮ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও ১০২ জন। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) এই হামলা চালানো হয়, যা ইয়েমেনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ মার্কিন সামরিক অভিযানের একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা ও হুথি নিয়ন্ত্রিত আল মাসিরাহ টিভি এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
আল মাসিরাহ টিভির বরাত দিয়ে ইয়েমেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই শ্রমিক এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট বেসামরিক কর্মী ছিলেন। গুরুতর আহত অনেককে রাজধানী সানা ও হোদাইদাহ শহরের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে কয়েক ডজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
মার্কিন সেনাবাহিনী দাবি করেছে, হুথি বিদ্রোহীদের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংস করতেই এই হামলা চালানো হয়েছে। লোহিত সাগর সংলগ্ন জলপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রক্ষায় হুথিদের হামলা ঠেকানো এবং তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হ্রাস করাই এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল বলে দাবি করে তারা।
মার্কিন কেন্দ্রীয় কমান্ড (CENTCOM) এক বিবৃতিতে জানায়, "এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল হুথিদের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে দুর্বল করা, যাতে তারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত করার জন্য আর সামর্থ্য না পায়।" এক্স প্ল্যাটফর্মে দেওয়া পোস্টে আরও বলা হয়, হুথি গোষ্ঠী যদি লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের ওপর হামলা বন্ধ না করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র এমন অভিযান অব্যাহত রাখবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রাসী কৌশল
দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হুথিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইয়েমেনজুড়ে ধারাবাহিক বিমান হামলায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১২৩ জন, যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলেন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক—এমনকি নারী ও শিশুও।
তথ্য মতে, শুধুমাত্র এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনেই মার্কিন বাহিনীর হামলায় আহত হয়েছেন আরও ২৪৭ জন, যার মধ্যে অনেকেই এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই হামলাগুলিকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং বেসামরিক জনগণের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
হুথিদের প্রতিক্রিয়া: পিছু হটার প্রশ্নই ওঠে না
যদিও যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক ভয়াবহ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে হুথি বিদ্রোহীরা কোনোভাবেই আত্মসমর্পণের পথে হাঁটছে না। বরং তারা আরো প্রতিজ্ঞাবদ্ধভাবে সামরিক প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এক বিবৃতিতে হুথি মুখপাত্র জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ এবং গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন চলমান থাকা পর্যন্ত তারা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখবে।
হুথিদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় এবং ইয়েমেনকে তার একটি পরীক্ষাগার বানিয়ে রেখেছে। গাজা পরিস্থিতিকে সামনে রেখে তারা তাদের প্রতিরোধ যুদ্ধকে ‘ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব’ বলে আখ্যা দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবিক সংকট
হামলার পরপরই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা ইয়েমেনে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সামরিক হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে এবং পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য একটি নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিও তুলেছে।
ইয়েমেনে বর্তমানে এক চরম মানবিক সংকট চলছে। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাস ইসা তেল বন্দরটি ধ্বংস হওয়ার ফলে জ্বালানি সরবরাহে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের জীবনে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই হামলা ইয়েমেনের পুনরুদ্ধার ও শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলবে।
সারসংক্ষেপে, ইয়েমেনে মার্কিন হামলা একদিকে যেমন বিদ্রোহীদের সামরিক শক্তি দমনে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের অংশ, অন্যদিকে এটি দেশটির ভঙ্গুর মানবিক বাস্তবতাকে আরও সংকটময় করে তুলছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা ও উদাসীনতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—কে আসলে যুদ্ধ চায়, আর কে চায় শান্তি?
বাংলাবার্তা/এমএইচ