
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় চলমান ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠন হামাস ঘোষণা দিয়েছে, গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও ইসরাইলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার নিশ্চিত করা হলে তারা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে আটক থাকা সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত রয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) এক টেলিভিশন ভাষণে হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং আলোচনা দলের প্রধান খলিল আল-হাইয়া এই ঘোষণা দেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে।
স্থায়ী শান্তির বিনিময়ে ‘সম্পূর্ণ জিম্মিমুক্তি’ প্রস্তাব
রয়টার্সের বরাতে জানা গেছে, টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এই ভাষণে খলিল আল-হাইয়া সাফ জানিয়ে দেন, হামাস কোনো ‘আন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি’ বা অস্থায়ী সমাধানে আগ্রহী নয়। তিনি বলেন, “আমরা এমন কোনো আপসের পথে হাঁটবো না যা কেবল যুদ্ধকে বিলম্বিত করে বা ইসরাইলের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে শক্তিশালী করে। বরং একটি বিস্তৃত প্যাকেজ চুক্তির আওতায় আমরা প্রস্তুত আছি সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে।”
হামাসের এই নেতার মতে, প্রকৃত শান্তির জন্য তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে:
১. গাজা উপত্যকায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি,
২. ইসরাইলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার,
৩. গাজা পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি।
তিনি আরও বলেন, “নেতানিয়াহু ও তার সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে। তারা চায় না কোনো স্থায়ী সমাধান হোক, বরং তারা গণহত্যাকে আড়াল করতে সাময়িক চুক্তির নাটক করতে চায়। আমরা সেই ফাঁদে পা দেবো না।”
ইসরাইলি আগ্রাসন অব্যাহত, একদিনেই নিহত অন্তত ৪৮
হামাসের এই ঘোষণার মধ্যেই গাজার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বৃহস্পতিবার দিনভর গাজার বিভিন্ন এলাকায় চালানো ইসরাইলি বিমান ও স্থল হামলায় কমপক্ষে ৩৫ জন নিহত হন। এর পরদিন শুক্রবার সকালে খান ইউনিসের একটি আবাসিক ভবনে চালানো ইসরাইলি বোমা হামলায় একটি একই পরিবারের ১৩ জন সদস্য নিহত হন। নিহতদের মধ্যে রয়েছে শিশু ও নারী।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত এক মাসে ইসরাইলি সেনাদের ফের শুরু করা অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত দেড় হাজার ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। সেই সঙ্গে অবরুদ্ধ উপত্যকায় প্রবেশ করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে খাদ্য, পানি ও ওষুধবাহী ত্রাণ ট্রাক, যা পরিস্থিতিকে আরও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির পরিহাস: চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়েই পৌঁছায়নি ইসরাইল
গত ১৯ জানুয়ারি কাতার, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল, সেটি তিনটি ধাপে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
প্রথম ধাপে: যুদ্ধ বন্ধ ও আংশিক জিম্মি-বন্দি বিনিময়,
দ্বিতীয় ধাপে: পূর্ণ জিম্মি-বন্দি বিনিময় ও ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার,
তৃতীয় ধাপে: গাজা পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক তদারকি।
তবে ইসরাইল চুক্তির প্রথম ধাপে অংশ নিলেও দ্বিতীয় ধাপে না গিয়েই গত ১৮ মার্চ থেকে আবার পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করে, ফলে পুরো চুক্তি মুখ থুবড়ে পড়ে। যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি ভেঙে দেওয়া এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই ফিলিস্তিনি জনগণের মাঝে ক্ষোভের নতুন বিস্ফোরণ শুরু হয়।
ইসরাইলের ভেতরেই যুদ্ধবিরোধী গণআন্দোলন
শুধু ফিলিস্তিনিরাই নয়, যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবার ফুঁসছে ইসরাইলের সাধারণ মানুষও। ‘রিস্টার্ট ইসরাইল’ নামের একটি জনপ্রিয় যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে ইতোমধ্যে ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ বিভিন্ন পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন। তারা দাবি তুলেছেন—জিম্মিদের মুক্তির জন্য আলোচনায় ফিরে আসা এবং গাজায় হামলা বন্ধ করা হোক।
এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন ইসরাইলি সেনা, সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা, মানবাধিকারকর্মী, লেখক, শিল্পী এবং রাজনীতিকরা। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক, একাধিক সেনাপ্রধান, ও বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী। এই পদক্ষেপ ইসরাইলি জনমতের ভিন্নমুখী রূপ তুলে ধরেছে, যেখানে অনেকেই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর যুদ্ধনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
হামাসের পক্ষ থেকে দেওয়া সর্বশেষ প্রস্তাব স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, গাজায় চলমান সংকটের একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান এখনো সম্ভব, যদি ইসরাইল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রকৃত শান্তির দিকে অগ্রসর হয়। তবে নেতানিয়াহুর সরকার যেভাবে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে এবং শান্তি আলোচনার পথে না এসে আগ্রাসন জারি রেখেছে, তাতে ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল।
হামাসের ভাষায়, “যতদিন ইসরাইল দখলদার থাকবে, ততদিন ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ চলবেই।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ