
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের জন্য চার বছর আগে চালু করা বিশেষ ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা হঠাৎ করেই বাতিল করেছে ভারত। বিষয়টি নিয়ে তৈরি হওয়া কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে এবার মুখ খুলেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল এই বিষয়ে ভারত সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন।
এসময় তিনি বলেন, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভারত ‘বাংলাদেশ সাইডে কী কী হয়েছে, সেটিও বিবেচনা করেছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, “আপনাদের আমি শুধু এটুকুই মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা এই ঘোষণা দেওয়ার আগে কী কী ঘটেছে, তা বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” যদিও তিনি সরাসরি কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা বা কার্যকারণের নাম উল্লেখ করেননি, তবে তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে ভারতের অসন্তোষের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
এতদিন ভারত থেকে আসা পণ্য সহজেই বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে ত্রয়ী হিমালয় রাষ্ট্র—নেপাল ও ভুটানে পাঠানো যেত। ২০২০ সালে ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তির অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো ভারতকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ। ফলে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সড়ক ও রেলপথে সহজেই নেপাল ও ভুটানে পৌঁছাতে পারছিল।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, তারা বাংলাদেশের মাধ্যমে নিজেদের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করছে। ভারতীয় পক্ষের যুক্তি ছিল, বিমানবন্দর এবং স্থল বন্দরে পণ্যজট এবং অব্যবস্থাপনার কারণে এই সুবিধা আর কার্যকর থাকছে না। সেই সাথে তারা তখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত দেয়, যদিও স্পষ্টভাবে কোনও ব্যর্থতার বিবরণ দেয়নি।
তবে বৃহস্পতিবারের ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল কিছুটা স্পষ্ট করেন যে, এই সিদ্ধান্ত একতরফা নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, “ঘটনাপ্রবাহের একটি পটভূমি রয়েছে, যেটা কেবল ট্রান্সশিপমেন্টের প্রযুক্তিগত দিক নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকেও প্রাসঙ্গিক।”
এদিকে অনেকের ধারণা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের সাম্প্রতিক উষ্ণতা ভারতের এই সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, একই দিনে ভারতের এই মন্তব্য আসে যেদিন ঢাকায় দীর্ঘ ১৫ বছর পর পাকিস্তানের সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দুই পক্ষই সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করে। একইসাথে চলতি মাসেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার-এর ঢাকা সফরের কথা রয়েছে।
ভারত এমন সফর ও সম্পর্কোন্নয়নের দিকে নজর রাখছে বলেও জানিয়েছেন মুখপাত্র জয়সোয়াল। তিনি বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে।” তবে তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গত, ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের নানা ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা রয়েছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ ভারতকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রাখছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এই সুবিধা বাতিল করায় দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে।
তবে ভারতীয় মুখপাত্র জয়সোয়াল বলেন, “ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ থেকে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সংযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গঠনমূলক এবং ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নেওয়ার আগ্রহ রয়েছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত হয়তো এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। তা শুধু ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নয়, বরং কূটনৈতিক আচরণ ও নীতির প্রতিও ইঙ্গিতবাহী। একইসাথে এর মাধ্যমে ভারত হয়তো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের সূক্ষ্ম কৌশল খেলছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের সাম্প্রতিক উষ্ণতা মাথায় রেখেই।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য কাঠামোতে এই পরিবর্তন কী প্রভাব ফেলে—তা এখন সময়ই বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ