
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব রাজনীতির নতুন উত্তাপ যেন এখন জাহাজ নির্মাণ ও বন্দর ব্যবস্থাপনাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। চলমান যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনার মধ্যে এবার চীনা নির্মিত ও পরিচালিত বাণিজ্যিক জাহাজের উপর নতুন করে বন্দর ফি আরোপের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা এমন এক সময় এলো, যখন বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় চীন ব্যাপকভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব জাহাজ নির্মাণ শিল্প অতীতের তুলনায় অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এই নতুন সিদ্ধান্তে বোঝা যাচ্ছে, চীনের বিপরীতে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিরোধ গড়তে যুক্তরাষ্ট্র এবার সমুদ্রপথের বাণিজ্যকেও কৌশলগতভাবে ব্যবহার করতে চায়।
চীনা আধিপত্য রোধে আমেরিকান জাহাজ শিল্পে নতুন প্রাণ সঞ্চারের উদ্যোগ
এই নতুন বন্দর ফি আরোপের ঘোষণা দেন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। তাঁর ভাষ্যমতে, “আমেরিকার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যের অবাধ প্রবাহের জন্য জাহাজ এবং জাহাজ চলাচল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই খাতকে চীনের প্রভাব থেকে রক্ষা করাই এখন সময়ের দাবি।”
এই ঘোষণা অনুসারে, এখন থেকে মার্কিন বন্দরে প্রত্যেকটি চীনা নির্মিত বা চীনা মালিকানাধীন জাহাজকে অতিরিক্ত ফি গুনতে হবে। ফিগুলো নির্ধারিত হবে টনেজ ও কন্টেইনার সংখ্যা অনুযায়ী। এ ক্ষেত্রে প্রতি কন্টেইনারে ১২০ ডলার পর্যন্ত ফি ধার্য হতে পারে। যেমন, যদি কোনো জাহাজে ১৫,০০০ কন্টেইনার থাকে, তাহলে অতিরিক্ত ফি দাঁড়াবে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন ডলার—যা একক ভ্রমণের জন্য বিশাল অঙ্ক।
এ ফি অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
৭০ বছরের অবনতি আর এশিয়ার উত্থান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাহাজ নির্মাতা দেশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই খাতের গতি কমে আসে। বর্তমানে মার্কিন জাহাজ নির্মাণ শিল্প বিশ্ব জাহাজ নির্মাণের মাত্র ০.১ শতাংশে সীমাবদ্ধ। বিপরীতে, আজকের দিনে চীন একাই বিশ্বের প্রায় অর্ধেক বেসামরিক জাহাজ নির্মাণ করে। এরপর রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান বলছে, এই তিনটি এশীয় দেশ একত্রে বেসামরিক জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ৯৫ শতাংশেরও বেশি অংশীদার। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার জন্য নিজেদের শিল্প পুনরুজ্জীবিত করা কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং কৌশলগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমেরিকান অর্ডার দিলে ফি মওকুফ, এলএনজি জাহাজেও শুল্ক আসছে
নতুন ঘোষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। কেউ যদি মার্কিন নির্মিত জাহাজের জন্য অর্ডার দেয়, তবে তার উপর বন্দর ফি মওকুফ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে ট্রাম্প প্রশাসন।
এছাড়াও, শুধুমাত্র চীনা জাহাজ নয়, অন্যান্য অ-মার্কিন নির্মিত গাড়ি পরিবহনকারী জাহাজ এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পরিবহনকারী জাহাজের উপরও নতুন ফি আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে। এলএনজি পরিবহনকারী জাহাজের জন্য নির্ধারিত ফি আগামী তিন বছরের মধ্যে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে, চীনের তৈরি শিপ-টু-শোর (STS) ক্রেন এবং কার্গো হ্যান্ডলিং সরঞ্জামের ওপরও নতুন করে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব সরঞ্জাম বর্তমানে বিশ্বের বহু বন্দরে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে চীন চাইলে গোয়েন্দা নজরদারি চালাতে পারে। এ আশঙ্কার ভিত্তিতে এদের প্রতিও এখন নজরদারি বাড়াচ্ছে ওয়াশিংটন।
মার্কিন খুচরা ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
অবশ্য নতুন এই ফি ঘোষণায় উদ্বিগ্ন মার্কিন খুচরা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৩০টি শিল্পসংস্থার একটি জোট। তাঁরা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, এই ফি আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়াবে এবং এর ফলে সাধারণ ভোক্তাকেই এর চরম মূল্য দিতে হবে। এই জোটের মতে, মার্কিন বাজারে এর প্রভাব পড়বে দুইভাবে—একদিকে দ্রব্যমূল্য বাড়বে, অন্যদিকে সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ যতই যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ নির্মাণ খাতকে রক্ষা ও চীনা আধিপত্য প্রতিহত করার জন্য হোক না কেন, এর প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর, বিশেষ করে যখন সারা বিশ্ব এখনো কোভিড-পরবর্তী জটিলতা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাধাগ্রস্ত বাণিজ্য পরিস্থিতি সামলাতে ব্যস্ত।
বাণিজ্য যুদ্ধের আরও এক ধাপ?
এই নতুন বন্দর ফি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে নিজ দেশের শিল্প রক্ষায় সক্রিয় হয়েছে, অন্যদিকে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধে নতুন এক ধাপ যুক্ত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ যদি চীন পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, তাহলে দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা আরও জটিল হতে পারে।
বিশ্ব বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই পরাশক্তির চলমান সংঘাত শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না—এর প্রভাব পড়বে সমগ্র বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায়, যা শেষমেশ ভোগান্তি বাড়াবে সাধারণ ভোক্তাদেরই। এখন দেখার বিষয়, এই সিদ্ধান্ত চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক আলোচনার নতুন দ্বার খুলবে, নাকি দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ