
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি ওয়াকফ সম্পত্তি আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ ঘিরে যে সহিংসতা ছড়িয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তবে ঢাকা থেকে আসা এই মন্তব্যকে একেবারেই ‘অপ্রয়োজনীয়’ এবং ‘লোক দেখানো’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে দিল্লি। বিষয়টি ঘিরে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক মঞ্চে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘু সুরক্ষায় উদ্বেগ জানায়
১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ঢাকায় গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, “আমরা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই।”
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ সরকার মুসলিমদের ওপর সাম্প্রতিক হামলা এবং জানমালের নিরাপত্তাহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং তা জোরালোভাবে নিন্দা করছে।
এই বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে এক ধরনের মানবাধিকার ও প্রতিবেশী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক অবস্থান হিসেবেই দেখছেন অনেকে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে একেবারে ভিন্নভাবে।
ভারত বলছে, এই মন্তব্যের কোনো প্রয়োজন ছিল না
বাংলাদেশ সরকারের এই মন্তব্যের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মন্তব্য আমরা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। এটি একেবারে অপ্রয়োজনীয় এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পাশাপাশি এটি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে ভারতের পূর্ববর্তী উদ্বেগগুলোর সঙ্গে তুলনার একটা অপচেষ্টা।”
রণধীর জয়সওয়ালের মন্তব্যে স্পষ্ট যে, দিল্লি এই বিবৃতিকে শুধুমাত্র প্রতিবেশীর সৌহার্দ্যপূর্ণ উদ্বেগ নয়, বরং নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
কী ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গে?
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হুগলি জেলায় ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাজ্য সরকারের নতুন ওয়াকফ আইন সংশোধন। এই আইনের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ মনে করে, এটি ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে এবং তাদের দীর্ঘদিনের সম্পত্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে।
বিক্ষোভ শুরুর পর পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও রাস্তা অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, পুলিশি ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ এবং যানবাহনে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এতে বেশ কিছু এলাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও অনেকে আহত হয়।
এই সহিংসতা ঘিরে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। রাজ্য সরকার ঘটনাকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও বিরোধীরা সরকারের নীতির কঠোর সমালোচনা করেছে। এই সময় আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি আলোচনায় আসে যখন বাংলাদেশ সরকার সরাসরি বিবৃতি দেয়।
অতীতেও ছিল সংখ্যালঘু ইস্যুতে মনোমালিন্য
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। তবে সময়-সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন কিংবা ধর্মীয় সহিংসতা সংক্রান্ত ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্তি দেখা গেছে। ভারত বরাবরই বলে আসছে, তারা একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে সকল ধর্মের মানুষ সমানাধিকার পায়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে কিছু অঞ্চলে সংঘর্ষ ও নির্যাতনের ঘটনা দেশটির ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক মহলে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এমন কিছু সময় দেখা গেছে, যখন ভারত উদ্বেগ জানিয়েছে—বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে।
তবে এবার ভারত সরাসরি অভিযোগ তুলছে—বাংলাদেশ এই মন্তব্য করে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে, এবং এই ভাষ্য মূলত কূটনৈতিক রীতিনীতির পরিপন্থী।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ
এই দ্বিপাক্ষিক টানাপোড়েনের ঘটনাটি এখন শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজরেও আসছে। জাতিসংঘের সংখ্যালঘু অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন নথিতে ইতিপূর্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ঘিরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষ করে যখন এটি প্রতিবেশী দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করার আশঙ্কা তৈরি করে।
সম্পর্ক না কাঁপিয়ে কি উদ্বেগ জানানো সম্ভব?
বাংলাদেশের মন্তব্য কূটনৈতিকভাবে স্বাভাবিক, না কি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ—এই বিতর্ক এখন দুই দেশের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বলয়ের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে পরস্পরের প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা বজায় রাখা খুবই জরুরি, যাতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টিকে থাকে, তবে ন্যায় ও মানবাধিকারের প্রশ্নেও কেউ পিছিয়ে না পড়ে।
বর্তমানে দুই দেশই নির্বাচনী উত্তেজনা, অর্থনৈতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে চাপে রয়েছে। এই সময়ে এমন এক বিতর্ক নতুন করে আলোড়ন তুলেছে। তবে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা নির্ভর করবে দুই দেশের পরবর্তী কূটনৈতিক অবস্থানের উপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ