
ছবি: সংগৃহীত
ইয়েমেনের গুরুত্বপূর্ণ তেলবন্দর রাস ঈসায় যুক্তরাষ্ট্রের চালানো ভয়াবহ বিমান হামলায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ জনে, আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৭১ জন। হুথি নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আনিস আলাসাবাহি শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) গভীর রাতে হুথি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম উপকূলীয় এই তেলবন্দরে পরপর চারটি আঘাত হানে মার্কিন যুদ্ধবিমান। হামলার সময় সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের পাশাপাশি স্থানীয় ট্রাকচালকসহ বহু সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। হামলার ভয়াবহতায় হতাহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
আলজাজিরার সানা প্রতিনিধির বরাতে জানা গেছে, এই হামলা শুধু রাস ঈসা তেলবন্দরেই সীমাবদ্ধ ছিল না—যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী আরও অন্তত কয়েকটি স্থানে একই রাতে বিমান হামলা চালায়। তবে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলাটি হয়েছে রাস ঈসা বন্দরে, যেখানে তখনও কর্মীরা নিয়মিত কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলেন।
হুথি যোদ্ধাদের মতে, ইয়েমেনে এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী হামলা। তারা একে ‘নির্বিচার গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছে, এই হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
হামলার উদ্দেশ্য: হুথিদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ভাঙার চেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) দাবি করেছে, হুথি বিদ্রোহীদের জ্বালানি প্রাপ্তি ও তেল রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পথ রুদ্ধ করতেই এই হামলা চালানো হয়েছে।
তেলবন্দরটি ইয়েমেনের জন্য শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, মানবিক সহায়তার দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির প্রায় ৭০ শতাংশ রপ্তানি এবং ৮০ শতাংশেরও বেশি মানবিক সহায়তা এই বন্দর ছাড়াও হোদেইদা এবং আস-সালিফ বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে। রাস ঈসা তেলবন্দর তাই শুধু হুথিদের নয়, পুরো দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি অবকাঠামো।
আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ, দেশের অভ্যন্তরে ক্ষোভ
বেসামরিক হতাহতের ঘটনায় ইয়েমেনজুড়ে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে হামলার নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। হুথি কর্মকর্তারা বলছেন, এই হামলা তাদের মনোবল ভাঙতে পারবে না। প্রতিরোধ আরও তীব্র হবে।
হুথি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসের আল-আতিফি স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল আল-মাসেইরাহকে বলেন, “এই হামলা আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে দুর্বল করবে না বরং ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি আরও শক্তিশালী করবে। আমরা গাজাবাসীর পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাব।”
প্রতিক্রিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে হুথিরা
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরপরই শুক্রবার সকালে ইসরাইল জানায়, ইয়েমেন থেকে তাদের লক্ষ্য করে একটি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোড়া হয়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, তারা সফলভাবে মিসাইলটি ভূপাতিত করেছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে হুথি যোদ্ধারা ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরাইল সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক জাহাজ ও বাণিজ্যিক শিপিং রুটে হামলা চালিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে তারা শতাধিক হামলা চালিয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র বারবার হুমকি দিয়ে বলেছে, হুথিরা এসব হামলা বন্ধ না করলে তাদের ওপর বিমান হামলা অব্যাহত থাকবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া নীতির প্রতিফলন
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকেই হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। মার্চের শুরুতে মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইয়েমেনে ৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়।
তবে বৃহস্পতিবার রাতের হামলা তা ছাড়িয়ে গেছে। এটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা বলে আখ্যায়িত করছেন বিশ্লেষকরা।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ধরনের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধবিরোধী চুক্তির চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে এবং জাতিসংঘকে অবিলম্বে তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছে।
এতসব চাপ ও হামলার মধ্যেও হুথিরা ঘোষণা দিয়েছে, তারা পিছু হটবে না এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের সংহতি অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও জানিয়েছে, হুথিরা যখনই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে, তখনই যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না।
এই পরিস্থিতিতে ইয়েমেনের মানুষকে এক ভয়ঙ্কর মানবিক সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যা আগামী দিনগুলোতে আরও প্রকট হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র: আলজাজিরা, আল-মাসেইরাহ, সেন্টকম, রয়টার্স
বাংলাবার্তা/এমএইচ