
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা যখন চরমে, ঠিক তখনই মূল্যবান ধাতু সোনা আবারও ইতিহাস গড়ে তুলেছে। সোমবার আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম নতুন এক রেকর্ড ছুঁয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি ফেরাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ, ডলারের মান পতন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বাড়তে থাকা চাহিদা এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা—সব মিলিয়ে সোনার বাজারে এমন জোয়ার এসেছে।
রেকর্ড গড়ল স্পট গোল্ড ও মার্কিন ফিউচারস মার্কেট
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিনিচ মান সময় অনুযায়ী ০২:৪৬ মিনিটে স্পট মার্কেটে প্রতি আউন্স সোনার দাম ১.৭ শতাংশ বেড়ে ৩,৩৮৩.৮৭ ডলারে পৌঁছায়। এর আগে তাৎক্ষণিক লেনদেনের শুরুতেই রেকর্ড মূল্য ৩,৩৮৪ ডলারে বিক্রি হতে দেখা যায় সোনা। একই সময়ে মার্কিন বাজারে সোনার ফিউচারস কন্ট্রাক্টের দাম ২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৩৯৬.১০ ডলার প্রতি আউন্সে।
এই দাম শুধু এক দিনের রেকর্ড নয়, বরং এটি বিগত কয়েক দশকের সর্বোচ্চ রেট হিসেবেই উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি এড়াতে চাইছেন, তখন সোনার মতো সুরক্ষিত সম্পদের চাহিদা বেড়ে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
ডলারের পতন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা সোনায়
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে ডলারের ক্রমাগত দুর্বলতা। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ডলারের সূচক এখন গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সোনার প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করছে। ঐতিহ্যগতভাবে, ডলারের মান কমলে সোনার দাম বেড়ে যায়, কারণ তখন সোনা অন্যান্য মুদ্রার বিনিময়ে তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে পড়ে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের ফের উত্তেজনা
বিশ্লেষকেরা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির মূল চালক হচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ, যার নতুন ধাপ শুরু হয়েছে গত ২ এপ্রিল। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একসঙ্গে কয়েক ডজন দেশের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন। এই তালিকায় চীনকে বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়। যদিও অন্যান্য দেশের প্রতি ট্রাম্প কিছুটা নমনীয় অবস্থান নেন, চীনের ব্যাপারে তার মনোভাব কঠোরই থেকে যায়।
এর প্রতিক্রিয়ায় চীনও নিজেদের কঠোর অবস্থান তুলে ধরে পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। শুধু তাই নয়, চীন এমনকি সোমবার সরাসরি সতর্ক করে বলেছে—যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক চুক্তিতে যেতে চায়, তাদের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
ট্রাম্প প্রশাসনের টার্গেটে জেরোম পওয়েল
উল্লেখযোগ্যভাবে, ট্রাম্প প্রশাসন ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পওয়েল-এর উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। চলতি সপ্তাহেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক আক্রমণ চালিয়েছে হোয়াইট হাউস। এমনকি তাকে ফেডারেল রিজার্ভ থেকে অপসারণের চিন্তাভাবনাও করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই ঘটনা আর্থিক খাত এবং বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরও বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর চাহিদাও বাড়াচ্ছে দাম
শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরাই নয়, বিশ্বের বহু কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন সোনার দিকে ঝুঁকছে। আইজি মার্কেটের স্ট্র্যাটেজিস্ট ইয়েপ জুন রং বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন, শুল্কারোপ, এবং ভূরাজনৈতিক পরিবেশের জটিলতা—সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও এখন সোনাকে রিজার্ভ হিসেবে বিবেচনা করছে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে প্রতি আউন্স সোনার দাম সাড়ে তিন হাজার ডলারে পৌঁছানো অস্বাভাবিক হবে না।”
সোনার দামে ভবিষ্যৎ প্রবণতা
বিশ্লেষকেরা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, যদি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রানীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তাহলে সোনার চাহিদা বিশ্বজুড়ে আরও বাড়বে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করায় সোনা হয়ে উঠছে প্রধান বিনিয়োগ বিকল্প।
বিশ্ববাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, যেকোনো নতুন সংকট বা নেতিবাচক ঘোষণা মুহূর্তেই সোনার দামে আরও বড় রকমের প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশেও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা
বিশ্ববাজারে এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বাংলাদেশেও অনিবার্যভাবে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আগে থেকেই স্থানীয় বাজারে সোনার দাম উর্ধ্বমুখী, এবং আন্তর্জাতিক বাজারের এই নতুন রেকর্ড তা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে সোনার গহনা ও বিনিয়োগমূল্যবান সোনার পণ্য।
সর্বশেষ পরিস্থিতি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না এলে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা প্রশমিত না হলে সোনার এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে। ফলে সোনা শুধু মূল্যবান ধাতু নয়, আবারও একবার হয়ে উঠছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রতীক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ