
ছবি: সংগৃহীত
হংকংয়ের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে “নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ” আখ্যা দিয়ে এবার পালটা পদক্ষেপ নিলো বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রের ছয়জন কংগ্রেসম্যান, সরকারি কর্মকর্তা এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার প্রধানদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই পদক্ষেপটিকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী কূটনীতির জবাব হিসেবে উপস্থাপন করছে বেইজিং, যা দুই পরাশক্তির মধ্যে চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও ঘনীভূত করল।
সোমবার (২১ এপ্রিল) চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র চীনের মূল ভূখণ্ড এবং হংকংয়ের ছয়জন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সেই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা এবং চরম নিন্দা জানিয়ে আমরা পালটা নিষেধাজ্ঞা নিতে বাধ্য হয়েছি।”
চীনের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে হংকংয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নিয়ম ভঙ্গ করেছে। বিশেষ করে গত ৩১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র যে ছয় চীনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁরা জাতীয় নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থি রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মীদের দমন করেছেন।
জাতীয় নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত প্রয়োগ
২০২৩ সালে চীন হংকংয়ে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করে, যার অধীনে “বিদেশি ষড়যন্ত্র”, “বিচ্ছিন্নতাবাদ”, “রাষ্ট্রদ্রোহ” এবং “সন্ত্রাসবাদের” অভিযোগে যে কাউকে গ্রেপ্তার করা এবং বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়। এই আইনটি কার্যকর হওয়ার পরপরই হংকংয়ের অন্তত ১৯ জন প্রভাবশালী গণতন্ত্রপন্থি রাজনীতিবিদ ও কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এদের মধ্যে অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, কেউ কেউ ইউরোপ, কেউ আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। হংকং সরকার পালিয়ে যাওয়া ১৩ জনের পাসপোর্ট বাতিল করে এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জনপ্রতি এক লাখ ২৮ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার সমপরিমাণ পুরস্কার ঘোষণা করে।
এই পদক্ষেপের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র চীনের জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, হংকংয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চেষ্টায় ওই কর্মকর্তারা সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেছেন।
চীনের জবাব: পালটা নিষেধাজ্ঞা ও কড়া হুঁশিয়ারি
চীন তাদের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যেসব মার্কিন কর্মকর্তা ও এনজিও প্রধানদের যুক্ত করেছে, তাঁদের নাম এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি, তবে কূটনৈতিক সূত্র বলছে, এদের অনেকেই হংকংয়ে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত। গুও জিয়াকুন বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র হংকং সংক্রান্ত বিষয়ে ভবিষ্যতেও ভুল ও উস্কানিমূলক পদক্ষেপ চালিয়ে যায়, তবে চীনের পক্ষ থেকে আরও কঠোর, আরও গভীর পালটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বাণিজ্যিক উত্তেজনার নতুন অধ্যায়
এই কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ময়দানেও উত্তেজনা বাড়ছে। ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর নতুন করে উচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। প্রথমে ৩৪ শতাংশ হারে শুল্ক বসানো হয়, যা পরে বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। পালটা প্রতিক্রিয়ায় চীনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক যুদ্ধের ফলে কেবল চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতি ও কূটনৈতিক স্থিতিশীলতাও বড় ধরনের চাপে পড়তে পারে। হংকংকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই উত্তেজনা এখন কেবল একটি শহরের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্ন নয়, বরং আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্যের প্রেক্ষাপটে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের ইঙ্গিতও বহন করছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই পালটা নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে আরও কতটা তীব্র রূপ ধারণ করবে, তা নির্ভর করছে দুই দেশের নেতৃত্বের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। তবে হংকংয়ের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ এই লড়াইয়ের কেন্দ্রে থাকছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ