
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলের টানা সামরিক আগ্রাসনে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬২ জন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও বহু মানুষের আটকে থাকার শঙ্কা প্রকাশ করে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। নিহত ও আহতদের বেশিরভাগই নারী, শিশু ও বয়স্ক—যারা হামলার মুহূর্তে নিজেদের ঘরেই অবস্থান করছিলেন।
সোমবার (২১ এপ্রিল) এই তথ্য জানিয়েছে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা আনাদোলু, যা গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলি বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা, যার মধ্যে খান ইউনুস, নুসাইরাত এবং রাফাহ ছিল সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অ্যাশরাফ আল-কুদরা জানান, সোমবার পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় গাজায় মোট ৫১ হাজার ২৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৩১ জন। তিনি বলেন, “আমরা প্রতিদিন গণকবরে আরও লাশ দাফন করছি, অথচ ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অগণিত মানুষ জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় চাপা পড়ে আছেন। উদ্ধারকর্মীরা নিরাপদে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারছেন না।”
যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন রক্তপাত
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। এরপর টানা কয়েক মাসের বোমাবর্ষণ ও সামরিক অভিযানে গাজা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীর চাপে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে। তবে এই যুদ্ধবিরতি ছিল বেশ স্বল্পস্থায়ী।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আবারও গাজায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। ইসরাইল দাবি করে, হামাসের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে না। এ অবস্থান ঘিরে পুনরায় সংঘর্ষ শুরু হয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ১৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে ইসরাইলি বিমান হামলায় ১ হাজার ৮৬৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও প্রায় ৪ হাজার ৯০০ জন আহত হয়েছেন। এই হামলাগুলো প্রায় প্রতিদিনই চালানো হচ্ছে এবং লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে আবাসিক ভবন, স্কুল, বাজার ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে।
রাফাহ সীমান্তে মানবিক বিপর্যয়
সবচেয়ে করুণ অবস্থা এখন রাফাহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী একাধিকবার এই অঞ্চলে ‘চূড়ান্ত অভিযান’ চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। অথচ এই এলাকাতেই আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ১২ লাখ গাজাবাসী, যারা আগের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে এসে রাফাহকে শেষ আশ্রয় ভেবেছিলেন।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বারবার ইসরাইলকে এই এলাকায় হামলা না চালানোর আহ্বান জানিয়ে আসছে। তবুও সেখানে প্রায় প্রতিদিনই বোমা বর্ষণ চলছে। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসেবা সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গর্ভবতী নারী, শিশু ও গুরুতর আহত রোগীরা ঘন্টার পর ঘন্টা চিকিৎসার অপেক্ষায় রাফাহ ও খান ইউনুসের ভেঙে পড়া হাসপাতালগুলোর আশেপাশে পড়ে থাকছেন।
আন্তর্জাতিক নিন্দা ও নিষ্ক্রিয়তা
এতো ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, রেড ক্রস ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গাজায় চলমান হামলাকে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করলেও ইসরাইলের ওপর কার্যকর কোনো আন্তর্জাতিক চাপ দৃশ্যমান নয়।
বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধিতা না করায় প্রশ্ন উঠছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকারিতা নিয়েও। গত সপ্তাহে আবারও জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর মুখে পড়ে বাতিল হয়ে যায়।
টানা ১৫ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধ গাজাকে শুধু ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেনি, বরং পুরো বিশ্বের মানবতাবোধ, আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের বিশ্বাসকেও গভীরভাবে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। শিশুদের কান্না, নারীদের আর্তনাদ এবং ধ্বংস হওয়া স্কুল-হাসপাতালগুলো শুধু গাজার গল্প নয়—এটা হয়ে উঠেছে বিশ্ববিবেকের এক মর্মান্তিক ব্যর্থতা।
গাজার মানুষের আজ প্রশ্ন—তাদের জীবনের মূল্য কি সত্যিই বিশ্বরাজনীতির কাছে এতটাই তুচ্ছ?
বাংলাবার্তা/এমএইচ