
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা যত বাড়ছে, ততই চাহিদা বাড়ছে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম স্বর্ণের। গত কয়েক মাস ধরে স্বর্ণের দাম বাড়ার ধারা অব্যাহত থাকলেও এপ্রিল মাসে তা যেন রীতিমতো রকেট গতিতে ছুটে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম ইতিমধ্যেই ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর ছায়া পড়েছে বাংলাদেশের বাজারেও, যেখানে এক ভরি স্বর্ণের দাম পৌঁছেছে সর্বকালের সর্বোচ্চে।
রেকর্ড ভাঙার দৌড়ে বিশ্ববাজারের স্বর্ণ
বিশ্ববাজারে স্পট মার্কেটে সোমবার (২১ এপ্রিল) স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে ৩ হাজার ৪১৫ দশমিক ২৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা সেশনের শুরুতে পৌঁছেছিল রেকর্ড ৩ হাজার ৪২৪ দশমিক ২৫ ডলারে। ফিউচার মার্কেটেও স্বর্ণের দাম ছুঁয়েছে ৩ হাজার ৪২৬ দশমিক ৩০ ডলার, যা আগের দিনের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঊর্ধ্বগতির মূল কারণ ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলারের দুর্বলতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শঙ্কা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ মজুতের প্রবণতা এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নিরাপদ সম্পদ অর্জনের আগ্রহ।
ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন: অনিশ্চয়তার নামান্তর
বিনিয়োগকারীদের এই আগ্রহের পেছনে কাজ করছে একাধিক আন্তর্জাতিক সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো অব্যাহত, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত আরও বিস্তৃত হচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। এমন অস্থির সময়ে যারা শেয়ারবাজার বা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে বিনিয়োগ করতে সাহস পান না, তারা ঝুঁকছেন পরীক্ষিত নিরাপদ আশ্রয় স্বর্ণের দিকে।
বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের মানসিকতায় নিরাপত্তার চাহিদা স্পষ্ট, এবং ইতিহাস বলছে—স্বর্ণই সেই চাহিদা পূরণের সবচেয়ে পুরোনো ও কার্যকর উপায়।
ডলারের দুর্বলতা: স্বর্ণের উল্লম্ফনের সহায়ক শক্তি
ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাতে পারে—এই সম্ভাবনা ডলারের ওপর চাপ তৈরি করেছে। ফলত, ডলারের মান তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। যেহেতু স্বর্ণের দাম সাধারণত ডলারের বিপরীতে ওঠানামা করে, ডলারের দুর্বলতাই স্বর্ণকে করেছে আরও আকর্ষণীয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ফেডারেল রিজার্ভের নীতিগত অনিশ্চয়তা এবং মার্কিন রাজনীতিতে বিভ্রান্তিকর বার্তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের প্রতি প্রকাশ্য অসন্তোষ এবং তাঁর অপসারণের গুঞ্জন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রহ: কৌশলগত সিদ্ধান্ত?
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, স্বর্ণ কিনছে শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা নয়, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ কাউন্সিলের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ব্যাপক হারে স্বর্ণ কিনেছে। ২০২৫ সালেও সেই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষ করে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে স্বর্ণ কেনার মাধ্যমে নিজেদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে স্বর্ণের অনুপাত বাড়াচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীন এখন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, স্বর্ণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য বিকল্প ভিত্তি তৈরির কৌশল নিচ্ছে।
এমন প্রবণতা বাজারে দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা তৈরি করছে, যা স্বর্ণের দামের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
বাজার বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস: উঁচুতে যাবে আরও
আইজি মার্কেটসের বিশ্লেষক ইয়াপ জুন রং মনে করছেন, ৩ হাজার ৫০০ ডলার হবে স্বর্ণের পরবর্তী মাইলফলক। তিনি বলছেন, বাজারের বর্তমান প্রযুক্তিগত সূচকগুলো অতিরিক্ত চাপের ইঙ্গিত দিলেও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর টেকসই চাহিদা দামকে আরও ওপরে ঠেলে দেবে।
ইউবিএস ব্যাংকের বিশ্লেষক জিওভান্নি স্টাউনোভো বলেন, ‘‘মার্কিন ডলারের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়ায় স্বর্ণের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারের দুর্বলতাও মানুষকে স্বর্ণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’’
বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসও পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছরের শেষ দিকে স্বর্ণের দাম ৩,৭০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। তাদের মতে, এখন স্বর্ণ শুধু নিরাপদ আশ্রয় নয়, বরং লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশের বাজারেও প্রভাব: দাম ছুঁয়েছে ইতিহাস
বিশ্ববাজারের এই উল্লম্ফনের সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারে। সোমবার (২১ এপ্রিল) বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৪ হাজার ৭১৩ টাকা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকা নির্ধারণ করেছে।
২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি এখন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ৪১ হাজার ১৬৯ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ প্রতি ভরি ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৮০ টাকা।
২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ২৪ বার স্বর্ণের দাম পরিবর্তন করা হয়েছে—তার মধ্যে ১৮ বারই দাম বেড়েছে।
বিনিয়োগে করণীয়: ঝুঁকি বুঝে এগোনোই বুদ্ধিমানের
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বর্ণে বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। যদিও স্বর্ণ তাৎক্ষণিক মুনাফা দেয় না, তবে বিশ্ববাজারের পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি এখনো অন্যতম নিরাপদ বিনিয়োগ। যারা এই বাজারে আসতে চান, তাদের ধাপে ধাপে বিনিয়োগ ও বাজার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাজুসের প্রাইসিং অ্যান্ড মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, ‘‘ট্রাম্পের শুল্কনীতি, ফেডের সুদের হার, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা—সব মিলে স্বর্ণের বাজার অস্থির। তবে এই অস্থিরতা সাময়িক না স্থায়ী, সেটাই এখন দেখার বিষয়।’’
স্বর্ণ: ঐতিহ্য থেকে আধুনিক নিরাপদ সম্পদ
অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে, স্বর্ণ কেবল অলঙ্কার নয়, বরং একটি কৌশলগত সম্পদ। আধুনিক বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিমণ্ডলে এখন তা পরিণত হয়েছে নিরাপদ অথচ লাভজনক একটি উপায়ে।
যদিও বিনিয়োগে কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবে সঠিক সময়ে, সঠিক দামে ও ধাপে ধাপে বিনিয়োগ করা হলে স্বর্ণ হতে পারে একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। এই মুহূর্তে বৈশ্বিক বাজার ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সেটিই যেন সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ