
ছবি: সংগৃহীত
দুই দশকেরও বেশি সময় পরে আবারও যুদ্ধের কিনারায় দাঁড়িয়ে ভারত-পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা এবার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা অনেকের কাছেই ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের সময়কেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা জাগাচ্ছে। জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁও অঞ্চলে সাম্প্রতিক ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পরই এই উত্তেজনার সূত্রপাত। ভারত বরাবরের মতোই পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছে, আর ইসলামাবাদ তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এর পরপরই শুরু হয়েছে সীমান্তজুড়ে সামরিক প্রস্তুতি ও কূটনৈতিক যুদ্ধ।
মোদির হুঁশিয়ারি: ‘শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ধাওয়া করে শাস্তি’
বিহারের এক সমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত হামলাকারীদের ধাওয়া করে শাস্তি দেওয়া হবে।” তিনি আরও বলেন, “এই হামলা কেবল নিরীহ পর্যটকদের ওপর নয়, বরং এটি ভারতের আত্মার ওপর হামলা।” ১৪০ কোটি ভারতবাসীর ইচ্ছাশক্তিই সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করবে বলে মন্তব্য করেন মোদি। তিনি প্রথমে হিন্দিতে বক্তব্য দিলেও আন্তর্জাতিক বার্তা স্পষ্ট করতে ইংরেজিতে সন্ত্রাসীদের শাস্তির হুমকি দেন। তাঁর এ বক্তব্য বিশ্বে ভারতের কঠোর অবস্থান তুলে ধরেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আরব সাগরে যুদ্ধজাহাজ, সীমান্তে মিসাইল পরীক্ষা, আকাশে যুদ্ধবিমানের মহড়া
ভারতের তিন বাহিনীই এখন পূর্ণ প্রস্তুতিতে। নৌবাহিনী আরব সাগরে ‘আইএনএস সুরাত’ থেকে একটি দ্রুতগতির ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে সফল এন্টি-মিসাইল টেস্ট চালিয়েছে। স্থলবাহিনী রাজস্থানে ‘ম্যান পোর্টেবল অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল’ (MPATGM) সফলভাবে পরীক্ষা করেছে। আর বিমানবাহিনী রাফায়েল ও সু-৩০ যুদ্ধবিমান দিয়ে চালাচ্ছে ‘এক্সারসাইজ আক্রমণ’। এই মহড়ার ভিডিও ও ছবি প্রকাশ করে ভারত জানায়, তারা সবরকম সম্ভাব্য হামলার জন্য প্রস্তুত।
পাকিস্তানের পালটা প্রস্তুতি ও হুঁশিয়ারি
ইসলামাবাদও বসে নেই। করাচি উপকূলে ২৪ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তানের নৌবাহিনী। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, ভারত যদি সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে, তবে তা হবে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা।
পাকিস্তানের বিদ্যুৎমন্ত্রী আওয়াইস লেখারি বলেন, “সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করার মানে হল পানির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা। আমরা প্রতিটি ফোঁটা পানির জন্য আইনি, কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে লড়ব।” পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ একে “যুদ্ধের পদক্ষেপ” বলেও উল্লেখ করেন।
ভারত-পাকিস্তান: কূটনৈতিক যুদ্ধের ময়দানে
ভারত সরকারের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নতুন মাত্রা পেয়েছে উত্তেজনা:
সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত: বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হওয়া ১৯৬০ সালের এই চুক্তিকে একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে ভারত, যার প্রভাব সরাসরি পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা ও কৃষি ব্যবস্থায় পড়বে।
আটারি-ওয়াগা সীমান্ত বন্ধ: সীমান্ত দিয়ে সবধরনের চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বৈধ ভ্রমণকারীদের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ফিরে যেতে বলা হয়েছে।
সামরিক উপদেষ্টা বহিষ্কার: ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনের সামরিক কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, একইসঙ্গে দিল্লি থেকেও পাকিস্তানি সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
দূতাবাসে কর্মীসংখ্যা হ্রাস: দুই দেশের দূতাবাসেই কর্মীর সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ জন করা হবে।
সার্ক ভিসা বাতিল ও আকাশসীমা বন্ধ: পাকিস্তান ভারতের সব নাগরিকের সার্ক ভিসা বাতিল করেছে এবং তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছে (শুধু শিখ তীর্থযাত্রীদের বাদে)। পাশাপাশি ভারতের সব বিমান পরিবহন সংস্থার জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি: যুদ্ধের আশঙ্কা কতটা বাস্তব?
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষক হুসেইন হকানি বলেন, “দুই দেশের পরমাণু অস্ত্র থাকার পরও তারা যেভাবে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে বিশ্বের জন্য অশনিসংকেত।” পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মির বলেন, “ভারতের এই অবস্থান এবং পানিচুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। পালটা না দিলে সরকার জনসমর্থন হারাবে।” দিল্লিভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি বলেন, “ভারত এবার কেবল কথার মারপ্যাঁচে সীমাবদ্ধ নেই, কার্যত পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক ও সামরিকভাবে কোণঠাসা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা
চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া—তিন পরাশক্তিই দুই দেশকে শান্ত রাখার আহ্বান জানালেও ইতোমধ্যেই কূটনৈতিক পর্যায়ে বৈঠক শুরু করেছে। বেইজিংয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা দুই পক্ষকেই সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছি।” হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানায়, “উভয় দেশ যেন কূটনীতির পথে ফিরে আসে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।” রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের চূড়ান্ত রূপ নেওয়া রোধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এখনই সক্রিয় হওয়া।”
এক ফোঁটা পানি থেকেই যুদ্ধ?
পহেলগাঁও হামলা থেকে শুরু হয়ে পানির ফোঁটা নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এখন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দুই দেশের জনগণ, বিশ্ব সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের নজর এখন সীমান্তে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ পথে যাবে, না কি আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে গড়াবে, তা নির্ধারিত হবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ