
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবারও ছায়াযুদ্ধের আবহ তৈরি হয়েছে। কাশ্মীরের পর্যটননগরী পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক বহিষ্কার, সামরিক প্রস্তুতি ও কঠোর জলপথ-আকাশসীমা বিধিনিষেধের মাধ্যমে চলমান উত্তেজনা এখন প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত ও পাকিস্তানকে ‘সর্বোচ্চ ধৈর্য’ ধরার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মধ্যরাতের বার্তা
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকে দেওয়া এ বিবৃতিতে তিনি বলেন, “দুই দেশের মধ্যে দ্রুত পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্তের ফলে যে মাত্রার উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং দুই পক্ষকেই আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করে।”
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানান, গুতেরেস মনে করেন, “ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো বিরোধ কেবল শান্তিপূর্ণ ও পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমেই সমাধান হওয়া উচিত। অস্ত্র নয়, আলোচনার টেবিলেই শেষ হওয়া উচিত বিবাদের।”
পেহেলগামের হামলা: উত্তেজনার সূচনা
মঙ্গলবার বিকালে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পেহেলগামে একটি পর্যটক দল লক্ষ্য করে চালানো হয় নৃশংস হামলা। অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে প্রাণ হারান ২৫ ভারতীয় পর্যটকসহ মোট ২৬ জন। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার দায় পাকিস্তানকে চাপায় ভারত, দাবি করে হামলাটি পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী পরিচালিত। যদিও ইসলামাবাদ এই অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে।
মোদির হুঁশিয়ারি ও ভারতের কৌশলগত জবাব
হামলার একদিন পর, বৃহস্পতিবার বিহারে এক নির্বাচনী সমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “এই হামলাকারীরা এবং তাদের ষড়যন্ত্রকারীরা এমন শাস্তি পাবে, যা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে আমরা তাদের খুঁজে বের করব।” ভাষণের শেষাংশে ইংরেজি ব্যবহার করে মোদি এই বার্তাটি বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিতে চান বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
একই দিনে ভারতের সেনাবাহিনী রাজস্থানে অত্যাধুনিক ‘ম্যান-পোর্টেবল অ্যান্টি-ট্যাংক গাইডেড মিসাইল’-এর সফল পরীক্ষা চালায়। বিমানবাহিনী ‘এক্সারসাইজ আক্রমণ’ নামে রাফায়েল ও এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমান দিয়ে সীমান্ত এলাকায় মহড়া শুরু করে। নৌবাহিনীও আরব সাগরে আইএনএস সুরাত থেকে অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেমের সফল পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা দেয়।
পাকিস্তানের পাল্টা ব্যবস্থা ও কঠোর হুঁশিয়ারি
ভারতের পাঁচটি পদক্ষেপের পালটা জবাব দিতে গিয়ে পাকিস্তান বৃহস্পতিবার আটটি পাল্টা সিদ্ধান্ত নেয়। ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়— ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে বলা হয়, “এই চুক্তি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তি। এটি বাতিল বা স্থগিত করার অধিকার কোনো একক রাষ্ট্রের নেই। ভারতের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।”
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরতাজ আজিজ এই প্রসঙ্গে বলেন, “যদি ভারত সিন্ধুর প্রবাহ বন্ধ করে বা ভাটির দেশের অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে তা সরাসরি যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
এছাড়া পাকিস্তান ওয়াগা সীমান্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছে এবং ভারতীয়দের দেওয়া সার্ক ভিসা বাতিল করেছে। ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত সামরিক উপদেষ্টাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে দেশে ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানেও ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তা সংখ্যা ৩০-এ নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আঞ্চলিক উত্তেজনায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েরই দফায় দফায় যোগাযোগ হচ্ছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে যদি উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়, তবে তা কেবল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না— এর প্রভাব পড়বে গোটা অঞ্চলে।
নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, “ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপস নেই। আমরা শান্তি চাই, তবে সেটা দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে নয়।”
অন্যদিকে পাকিস্তানের বিদ্যুৎমন্ত্রী আওয়াইস লেখারি এক্সে লিখেছেন, “সিন্ধুর প্রতিটি ফোঁটায় আমাদের অধিকার। ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তকে আমরা শুধু প্রত্যাখ্যানই করছি না, এর বিরুদ্ধে আমরা প্রতিটি কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে লড়ব।”
পরিণতির আশঙ্কা ও শান্তির বার্তা
সীমান্তে সৈন্য বাড়ানো, যুদ্ধজাহাজ ও ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন, কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস এবং পারস্পরিক নিষেধাজ্ঞা— সব মিলিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের পর সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থানে পৌঁছেছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের শান্তির আহ্বান যেন শেষ আশার বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব নেতারা এখন তাকিয়ে আছেন দিল্লি ও ইসলামাবাদের দিকে— দেখার জন্য তারা সংঘাতের পথে এগোয়, নাকি শান্তিপূর্ণ আলোচনার টেবিলে ফিরে আসে। গুতেরেসের মতো কণ্ঠগুলো হয়তো আবারো প্রমাণ করতে পারবে, যুদ্ধ নয়, কূটনীতিই সভ্যতার শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ