
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিনের পুরোনো জ্বলন্ত ইস্যু কাশ্মীরকে ঘিরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবারও তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। একদিকে কাশ্মীরের পহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর পাল্টাপাল্টি গোলাগুলির ঘটনা—সব মিলিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পরিস্থিতি ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনেও কাশ্মীর ইস্যু ফিরে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রে। সব দেশের দৃষ্টি এখন বড় শক্তিগুলোর দিকে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র কী অবস্থান নেয়, সেটাই হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ।
পহেলগামে হামলা ঘিরে নতুন করে উত্তপ্ত কাশ্মীর
কাশ্মীরের পহেলগাম অঞ্চলে সাম্প্রতিক এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারায় ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ভারত দাবি করেছে, এই হামলার পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী। ভারত তৎক্ষণাৎ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়, সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়, এবং ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে অভিযোগ তোলে।
অন্যদিকে পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়ে দিয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একাধিক বিবৃতিতে ভারতের এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও ‘প্রোপাগান্ডা’ আখ্যা দেয়। শুধু তাই নয়, বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) রাতে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সংঘটিত গোলাগুলির পর পাকিস্তানও সুর চড়িয়ে বলে, ‘যদি আগুন আসে, জবাব পাটকেল দিয়ে নয়, ইট দিয়েই দেওয়া হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র বলছে—আমরা কোনো পক্ষ নিচ্ছি না
এই চরম উত্তেজনার মধ্যে দুই দেশই আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির অবস্থান এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু হোয়াইট হাউজ কিংবা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর—কোনো পক্ষই এখন পর্যন্ত সরাসরি একপক্ষের পক্ষাবলম্বন করেনি।
ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “কাশ্মীর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো তাৎক্ষণিক অবস্থান নিচ্ছে না। আমরা নিরপেক্ষ এবং পরিস্থিতির ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “এই অঞ্চলের দ্রুত বিকশিত ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আমরা অবগত এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছি। কোনো পক্ষের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে আমরা চাই, ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের সঙ্গে সরাসরি সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের পথ খুঁজে বের করুক।”
সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করলেও অবস্থানহীন যুক্তরাষ্ট্র
যদিও মার্কিন দপ্তর মুখপাত্র পহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করেছেন এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন, তবুও এটি ভারতের প্রতি সরাসরি সমর্থন নয়। তিনি বলেন, “আমরা এই হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করছি। যারা দায়ী, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”
তবে একইসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দেন, “এই ধরনের হামলা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়াও যেন এমন না হয় যা সামগ্রিক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে আরও দুর্বল করে দেয়।”
ট্রাম্পের পুরোনো মধ্যস্থতার প্রস্তাব এখন কোথায়?
এক সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছিলেন, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতার ভূমিকা নিতে আগ্রহী। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কের জন্ম দেয় এবং নয়াদিল্লি প্রকাশ্যে ট্রাম্পের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই পুরোনো প্রস্তাবের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ট্যামি ব্রুস বলেন, “এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো নতুন বিবৃতি দেননি। অতীতে যেটা বলা হয়েছে, সেটাই আপাতত আমাদের অবস্থান।”
এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছে যে, তারা এই মুহূর্তে কাশ্মীর ইস্যুতে সরাসরি হস্তক্ষেপ কিংবা পক্ষাবলম্বনের আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মত—সতর্ক অবস্থানে আমেরিকা
বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এখন অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ। ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার, আবার পাকিস্তানও একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ফলে কাশ্মীর ইস্যুতে একপক্ষের পক্ষে দাঁড়ানো মানেই অন্যপক্ষকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করা, যা ওয়াশিংটন কোনোভাবেই চাইছে না।
ভারত চায়, বিশ্ব সম্প্রদায় পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদে মদদদাতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিক। আর পাকিস্তান চায়, কাশ্মীরের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত হোক। এই দুই বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে উভয় দেশই এখন বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে।
কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা নাকি কৌশলগত নিরপেক্ষতা?
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান কি প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষতা, নাকি এটি একধরনের কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা? একাংশ মনে করে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখন এমন এক স্তরে রয়েছে, যেখানে কোনো পক্ষ না নিয়ে পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করাই সবচেয়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত। আবার আরেক পক্ষ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই নীরবতা শুধু ‘সময়ক্ষেপণ’, প্রয়োজনে তারা যে কোনো মুহূর্তে সক্রিয় হতে পারে।
বর্তমানে যদিও মার্কিন প্রশাসনের কোনো সরাসরি মন্তব্য নেই, তবুও আন্তর্জাতিক মহলের চোখ থাকবে ওয়াশিংটনের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের দিকে। কারণ, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যে কোনো সময় বদলে দিতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা চিত্রপট।
বাংলাবার্তা/এমএইচ