
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত বিমান হামলায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আরও অন্তত ৮৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৬৮ জন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি থেকে প্রাপ্ত খবরে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ এখনো বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। উদ্ধারকর্মীরা অনেক জায়গায় পৌঁছাতে পারছেন না। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের অনেককেই জীবিত বা মৃত অবস্থায় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত যাদের নিহত হিসেবে গণনা করা হয়েছে, তা বাস্তবতার তুলনায় অনেক কম।
ইসরাইলের চলমান হামলা নতুন নয়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে ‘আল-আকসা ফ্লাড’ নামের এক ঝটিকা অভিযানে হামাস প্রায় ১২০০ ইসরাইলিকে হত্যা এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ইসরাইল গাজায় সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৫১ হাজার ৪০০ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৬ জন। এই বিপুল সংখ্যক হতাহতদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু, যা পুরো যুদ্ধটিকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের রূপ দিয়েছে।
গত ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র এবং মিসর, কাতারসহ অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশের চাপে সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল ইসরাইল ও হামাস। কিন্তু এ যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব ছিল খুবই অল্প। মাত্র ৫৯ দিন পর, ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় নতুন করে হামলা শুরু করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। দ্বিতীয় দফার এই সামরিক অভিযানে মাত্র ৩৮ দিনের মধ্যেই ২০৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও ৫ হাজার ৩৭৫ জন।
এই দফার অভিযান আরও ভয়াবহ এবং লক্ষ্যভেদী। আইডিএফ সরাসরি গাজার দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের বহু বেসামরিক এলাকা, স্কুল, হাসপাতাল ও শরণার্থী শিবিরে বোমাবর্ষণ করেছে। জাতিসংঘসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা একে যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করেছে এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।
বিশেষ করে আল-মাওয়াসি, খান ইউনুস, ও নুসেইরাত এলাকায় বিমান হামলা এবং আর্টিলারি গোলাবর্ষণে শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই অঞ্চলগুলোতে যেহেতু হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন, তাই মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
অন্যদিকে, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা হামাসের সামরিক অবকাঠামো, সুড়ঙ্গপথ ও অস্ত্রাগার ধ্বংস করতেই এই অভিযান চালাচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, ইসরাইলি হামলায় হতাহতদের মধ্যে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে শিশুদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
গাজার হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম কার্যত বন্ধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, আহতদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন। হাজার হাজার মানুষ বিনা চিকিৎসায় ধুঁকছেন।
এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আবারও তাৎক্ষণিক, পূর্ণাঙ্গ এবং টেকসই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং ইসলামী সহযোগিতা সংস্থাসহ (ওআইসি) অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাও ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তুলেছে।
সামগ্রিকভাবে, ১৫ মাসের এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে মানবিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরে এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে। একদিকে মানবিক বিপর্যয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন—এই দ্বিমুখী সংকটে আজ পুরো গাজা উপত্যকা মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ