
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের হত্যার ঘটনায় চরম ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ায় উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারত। ঘটনার পরপরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার, যার অন্যতম হচ্ছে দেশটিতে বসবাসরত বা অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানো। এই প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য দেশের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
শুক্রবার দিনভর একাধিক মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন অমিত শাহ। তিনি তাদের স্পষ্টভাবে জানান, পাকিস্তানি নাগরিকদের দেওয়া ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। যাদের ভিসা ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই ভারতে অবস্থান করা থেকে বিরত রাখতে হবে এবং তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। তিনি বলেন, "এই বিষয়ে কোনো গাফিলতি বরদাশত করা হবে না। এটা ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন।"
বিশেষ করে দুই ধরণের ভিসাধারীদের উদ্দেশ্য করে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাধারণ ভিসাধারীদের ক্ষেত্রে ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং তা কার্যকর হবে শুক্রবার রাত থেকে—অর্থাৎ সিদ্ধান্ত ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টা পর। অন্যদিকে, যারা চিকিৎসার জন্য মেডিকেল ভিসায় ভারতে এসেছেন, তাদের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদের আগামী ২৯ এপ্রিলের মধ্যে ভারতে অবস্থান শেষ করে নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।
এই দুই নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য রাজ্য সরকারগুলোর প্রশাসনকে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিষয়টির উপর তিনি সরাসরি নজরদারি করছেন বলে জানিয়েছে ঘনিষ্ঠ সূত্র। যদিও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি, তবে দেশটির গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সব কটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অমিত শাহ ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে মুখ্যমন্ত্রীদের এই নির্দেশ দিয়েছেন।
এই সিদ্ধান্ত আসে এমন এক সময়ে, যখন কাশ্মীরের পেহেলগামে এক ভয়াবহ হামলায় নিহত হয়েছেন তিনজন নিরীহ পর্যটক। মঙ্গলবার এই হামলা চালায় সশস্ত্র জঙ্গিরা। যদিও কেউ এখনো গ্রেফতার হয়নি, তবে ভারতের কেন্দ্র সরকার দাবি করেছে, হামলাকারীরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার সদস্য। ইতোমধ্যে সন্দেহভাজন চারজনের পরিচয় প্রকাশ করেছে প্রশাসন। তাদের মধ্যে অন্যতম আসিফ শেখ এবং আদিল হুসেন ঠোকর। সরকারি তথ্য অনুসারে, আসিফের বাড়িতে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। অপরদিকে আদিল হুসেন ঠোকরের বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উভয়ের বাড়িই কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় অবস্থিত।
সরকারি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, হামলাকারীরা পাহাড়ি জঙ্গল ঘুরে হেঁটে বৈসারন এলাকায় পৌঁছায়, যাতে তারা সেনার নজর এড়িয়ে চলতে পারে। এই পথে চলাচল ও নির্ভুল গন্তব্যে পৌঁছাতে তারা ‘আল্পাইন কোয়েস্ট’ নামের একটি অ্যাপ ব্যবহার করে, যা মূলত অফলাইন ম্যাপিং ও নেভিগেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই অ্যাপ ব্যবহারের জন্য তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণও নিতে হয়েছে বলে তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এই ঘটনার পর থেকেই কেন্দ্র সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা কৌশলগত প্রতিক্রিয়া নিতে শুরু করেছে। এর মধ্যে শুধু পাকিস্তানিদের ভারতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নয়, ভিসা বাতিল, দূতাবাস পর্যায়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার জোরদার করাও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে বিহারে এক জনসভায় বলেছেন, “জঙ্গিদের খুঁজে বের করে তাদের এমন শাস্তি দেওয়া হবে, যা কল্পনারও বাইরে।”
পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন ভারতের কূটনৈতিক বার্তা হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে রাজ্য প্রশাসনগুলোর ওপরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ তাদেরকেই দ্রুতভাবে তালিকা প্রস্তুত, শনাক্তকরণ ও প্রত্যাবাসনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় অভিবাসন দপ্তর, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ।
এই নির্দেশের বাস্তবায়ন কিভাবে হয় এবং কত দ্রুত পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়, তার উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতের কূটনৈতিক সম্পর্ক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নীতির বাস্তব চিত্র। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ নির্বাচনের আগমুহূর্তে একটি শক্ত বার্তা দেওয়ার রাজনৈতিক কৌশলও হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ