
ছবি: সংগৃহীত
পেহেলগামে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ফের চরম উত্তেজনার দিকে এগোচ্ছে। কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে দিল্লি সরাসরি পাকিস্তানের ওপর হামলার অভিযোগ আনায় দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা ঘনীভূত হয়েছে। ভারতের প্রতিক্রিয়া আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠায় ইসলামাবাদও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, যদি সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে দুই দেশের সামরিক শক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
এই প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণমূলক প্ল্যাটফর্ম 'ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া' একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা, পারমাণবিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা বাজেটের বিস্তারিত তুলনা করা হয়েছে। এ ছাড়া 'গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স (জিএফপি) ২০২৫'–এর সামগ্রিক সূচকও বিশ্লেষণে যুক্ত করা হয়েছে।
সামগ্রিক র্যাঙ্কিং ও সামরিক সক্ষমতা
বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে সামগ্রিক সামরিক শক্তিতে ভারত অবস্থান করছে ৪ নম্বরে, স্কোর ০.১১৮৪ (যেখানে স্কোর যত কম, শক্তি তত বেশি)। অপরদিকে পাকিস্তান রয়েছে ১২তম স্থানে, স্কোর ০.২৫১৩। ভারতের এই উচ্চ স্থান তার বিপুল জনসংখ্যা, বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেট এবং বৈচিত্র্যময় সামরিক সম্পদের প্রকাশ। পাকিস্তান তুলনামূলক ছোট অর্থনীতি ও কম বাজেট থাকা সত্ত্বেও কৌশলগত স্থানে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রেখেছে, বিশেষ করে চীনের সামরিক সহযোগিতায়।
পারমাণবিক অস্ত্র ও কৌশলগত নীতি
ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই বিশ্বে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর তালিকায়। ভারতের হাতে রয়েছে আনুমানিক ১৩০–১৪০টি পারমাণবিক অস্ত্র। তাদের ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অগ্নি-থ্রি ও অগ্নি-ফাইভ ব্যালিস্টিক মিসাইল (পাল্লা যথাক্রমে ৩,০০০–৫,০০০ কিমি), মিরাজ ২০০০ ও রাফায়েল যুদ্ধবিমান, এবং আইএনএস আরিহান্ট সাবমেরিন। ভারত 'নো ফার্স্ট ইউজ' নীতিতে অটল, অর্থাৎ আক্রান্ত না হলে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করবে না; তবে আক্রান্ত হলে কঠোর প্রতিশোধ নেয়ার নীতি রয়েছে।
পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ভারত থেকে কিছুটা বেশি, ১৪০–১৫০টির মতো। পাকিস্তান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র আগেভাগে ব্যবহারের পক্ষপাতী ('ফুল স্পেকট্রাম ডেটারেন্স' নীতি)। তাদের ডেলিভারি সিস্টেমে রয়েছে শাহিন-টু/থ্রি ব্যালিস্টিক মিসাইল, বাবর ক্রুজ মিসাইল এবং এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। ফলে পারমাণবিক সক্ষমতায় পাকিস্তানও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে সক্ষম।
সেনা সংখ্যা ও জনশক্তি
জনবল সংগ্রহের দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় অনেক এগিয়ে। ভারতের সক্রিয় সেনা সদস্য সংখ্যা ২১ লাখ ৪০ হাজার, রিজার্ভ ১১ লাখ ৫৫ হাজার এবং যুদ্ধাবস্থায় মোট ৩১ কোটি মানুষের সেনাশক্তি ব্যবহারযোগ্য।
পাকিস্তানের সক্রিয় সেনা সদস্য ৬ লাখ ৫৩ হাজার, রিজার্ভ ৫ লাখ ১৩ হাজার এবং যুদ্ধকালীন জনশক্তি ৪ কোটির মতো। সংখ্যায় পিছিয়ে থাকলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে উচ্চ দক্ষতা প্রদর্শন করেছে, বিশেষ করে সীমিত প্রচলিত যুদ্ধ এবং গেরিলা কৌশলের ক্ষেত্রে।
স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর তুলনা
স্থলবাহিনী:
ভারতের স্থলবাহিনীর হাতে রয়েছে ৪ হাজার ৬১৪টি ট্যাংক, ৫ হাজার ৬৮১টি সামরিক যান এবং ২৯২টি রকেট আর্টিলারি ইউনিট।
অপরদিকে, পাকিস্তানের রয়েছে ২ হাজার ৭৩৫টি ট্যাংক, ৩ হাজার ৬৬টি সামরিক যান এবং ১৩৪টি রকেট আর্টিলারি ইউনিট।
বিমান বাহিনী:
ভারতের যুদ্ধবিমান সংখ্যা ২ হাজার ২১৬টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মডেল হলো মিগ-২১, মিগ-২৯, সুখোই-৩০ এমকেআই, জাগুয়ার ও মিরাজ ২০০০।
পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান সংখ্যা এক হাজার ১৪৩টি, যার মধ্যে রয়েছে চীনের এফ-৭ পিজি এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ ফেলকন। কোয়ালিটির বিচারে ভারতের বিমানবাহিনী সামগ্রিকভাবে এগিয়ে, তবে পাকিস্তান নির্দিষ্ট কৌশলগত অঞ্চলে চমৎকার প্রতিরক্ষা গড়তে সক্ষম।
নৌবাহিনী:
ভারতের নৌবাহিনীর রয়েছে ১৫টি সাবমেরিন, ১৫টি ফ্রিগেট, ১১টি ডেস্ট্রয়ার এবং দুটি বিমানবাহী রণতরী।
পাকিস্তানের রয়েছে পাঁচটি সাবমেরিন ও ৯টি ফ্রিগেট। সমুদ্রে ভারতের প্রাধান্য আরও সুস্পষ্ট হলেও পাকিস্তান উপকূলীয় প্রতিরক্ষায় নিজেকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।
প্রতিরক্ষা বাজেট
ভারতের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রতিরক্ষা বাজেট ৭৯ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ২.১ শতাংশ। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এই বাজেট, যা ভারতের সামরিক প্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক সহায়ক। ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম।
পাকিস্তানের বাজেট ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। বৈদেশিক সামরিক সহায়তার ওপর পাকিস্তানের নির্ভরতা (বিশেষত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর) বেশ উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের বাজেটের বড় অংশ চলে যায় বিশাল সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ ও পারমাণবিক অস্ত্র সুরক্ষার পেছনে।
যুদ্ধের সম্ভাবনায় কার অবস্থান কোথায়?
যদি সরাসরি প্রচলিত যুদ্ধ হয়, তাহলে ভারত তার বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেট, উন্নত প্রযুক্তি, বড় সেনা সংখ্যা এবং আধুনিক বিমান ও নৌবহরের কারণে পরিষ্কারভাবে এগিয়ে থাকবে। তবে পাকিস্তানের যুদ্ধনীতিতে দ্রুতগতির হামলা, আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা ও সম্ভাব্য আগাম পারমাণবিক হামলার কৌশল ভারতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধ হলে তা দীর্ঘমেয়াদি হবে না, বরং সীমিত আকারের সংঘর্ষ হতে পারে। উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে যুদ্ধের ঝুঁকির ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। তবু, সীমান্ত সংঘাত বা নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধের ঝুঁকি বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ