
ছবি: সংগৃহীত
ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র শহিদ রাজয়ি বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৭৫০ জন। শনিবার (২৬ এপ্রিল) দেশটির রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দক্ষিণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ এবং অন্যান্য সরকারি সূত্রগুলো এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে বন্দরের কনটেইনারে সংরক্ষিত রাসায়নিক দ্রব্যের অনিরাপদ মজুদকেই দায়ী করা হচ্ছে। ইরানের সংকট ব্যবস্থাপনা সংস্থার মুখপাত্র হোসেইন জাফরি জানান, "কনটেইনারের ভেতর রাসায়নিক দ্রব্য জমা করে রাখার যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার কারণেই বিস্ফোরণ ঘটে।" তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইতিপূর্বে সংকট ব্যবস্থাপনা বিভাগের পক্ষ থেকে শহিদ রাজয়ি বন্দরের কর্তৃপক্ষকে এই ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছিল এবং ঝুঁকির বিষয়ে সরাসরি অবহিতও করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রীয় টিভির সরাসরি সম্প্রচারে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের পর বন্দরের আকাশ ঘন কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে শতাধিক কনটেইনারে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পানি ছিটানোর দৃশ্যও প্রকাশ্যে এসেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্দরের বেশ কিছু অংশ এখনও দগ্ধ অবস্থায় রয়েছে এবং দমকল বাহিনী ও উদ্ধারকারী দল নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
এদিকে ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান এই ঘটনার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস্কান্দার মোমেনি সরাসরি ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন এবং উদ্ধারকাজ তদারকি করছেন। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, “আমরা ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটনে কোনো ধরনের গাফিলতি সহ্য করব না।”
প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান মেহরদাদ হাসানজাদে জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয় বন্দরের সংরক্ষিত কয়েকটি কনটেইনার থেকে। কিছু কনটেইনারে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ ছিল, যা অতিরিক্ত তাপ ও অব্যবস্থাপনার ফলে অগ্নিসংযোগ ও পরে শক্তিশালী বিস্ফোরণের কারণ হয়।
তিনি বলেন, "আমরা আহতদের উদ্ধার করে দ্রুত আশপাশের চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠিয়েছি। বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।"
বিশ্লেষকরা বলছেন, শহিদ রাজয়ি বন্দর ইরানের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ইরানের অন্যতম বৃহৎ কনটেইনার বন্দর, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য আমদানি-রপ্তানির বড় অংশ পরিচালিত হয়। বন্দরটি হরমুজ প্রণালির উত্তর দিকে অবস্থিত, যেখান দিয়ে বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ফলে শুধু ইরানের বাণিজ্য নয়, গোটা অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপরও প্রভাব পড়তে পারে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, উদ্ধারকারী বাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু করে। এখন পর্যন্ত শতাধিক দগ্ধ কনটেইনার চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থভর্তি ছিল। বন্দরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোরও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষণ বলছে, এত বড় দুর্ঘটনা ইরানের বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার দুর্বলতাকেই তুলে ধরছে। তাছাড়া, বন্দর এলাকায় দীর্ঘদিনের অব্যবস্থা, দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাবই এই বিস্ফোরণকে এত ভয়াবহ রূপ দিয়েছে।
সরকারি ঘোষণার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে প্রশাসনের অবহেলা এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন, যা এমন বড় বিপর্যয়ের জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমানে উদ্ধার ও অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত আছে। দেশটির সামরিক বাহিনী, দমকল বাহিনী এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা যৌথভাবে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে। ইরানের সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য বিশেষ সহায়তা তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছে আন্তর্জাতিক মহলও। কেননা, হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা বিশ্বের জ্বালানি বাজারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে এমন ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে শহিদ রাজয়ি বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ