
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ পর্যটক হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আবারও দারুণ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার নিয়ন্ত্রণরেখা (LoC)। দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে টানা তৃতীয় রাতেও গোলাগুলি চলেছে, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী রোববার সকালে জানায়, শনিবার দিবাগত রাতে জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর তুতমারিগালি ও রামপুর সেক্টরে পাকিস্তানি সেনারা বিনা উসকানিতে গুলি চালিয়েছে। জবাবে ভারতীয় সেনারাও পাল্টা গুলি চালায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন ধারাবাহিক সংঘর্ষ খুব বেশি দেখা যায়নি বলে সামরিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করছেন।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পাকিস্তানি সেনারা ‘ছোট অস্ত্র’ ব্যবহার করে ‘উসকানিমূলক গুলিবর্ষণ’ শুরু করে, যা যুদ্ধবিরতির চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এনডিটিভির দাবি অনুযায়ী, পাকিস্তান এ ধরনের লঙ্ঘন 'নিয়মিতভাবেই' করে আসছে।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নীরবতা
তবে পাকিস্তানের সরকার বা দেশটির মূলধারার সংবাদমাধ্যম এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। অতীতে এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সাধারণত ভারতকেই প্রথমে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের জন্য দায়ী করে বিবৃতি দেয়, তবে এই ঘটনার ক্ষেত্রে এখনো তাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের দিক থেকে নীরবতা কোনো কৌশলগত প্রস্তুতির ইঙ্গিত হতে পারে, অথবা তারা কাশ্মীরে আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনের কৌশলের অংশ হিসেবেও অপেক্ষা করতে পারে। পাকিস্তানভিত্তিক বিশ্লেষক হামিদ মির মন্তব্য করেছেন, "কাশ্মীরে কোনো ঘটনার পরে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য দেওয়া খুবই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান হয়তো আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতকে অভিযুক্ত করতে চাচ্ছে।"
পেহেলগামে হামলার রক্তাক্ত প্রেক্ষাপট
এই সাম্প্রতিক গোলাগুলির সরাসরি পটভূমি হলো ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত ভয়াবহ হামলা, যেখানে সশস্ত্র হামলাকারীরা পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করে। হামলায় আরও অন্তত ৩০ জন আহত হন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।
ভারত দাবি করেছে, এই হামলার সঙ্গে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের যোগাযোগ রয়েছে এবং হামলাকারীদের মধ্যে কমপক্ষে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে।
এই হামলার পর কাশ্মীর উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। একাধিক স্থানে অভিযানের সময় গোলাগুলি হয়েছে এবং কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, পেহেলগাম থেকে শুরু করে অনন্তনাগ পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে সেনা টহল জোরদার করা হয়েছে।
ভারতীয় প্রতিক্রিয়া ও পাকিস্তানের পাল্টা হুমকি
পেহেলগামের হামলার পর থেকেই ভারতের রাজনৈতিক মহলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি প্রবলভাবে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, 'পাকিস্তান যদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ না করে, তবে ভারত নিজের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় যেকোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।'
অন্যদিকে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এক বিবৃতিতে পাকিস্তান বলেছে, 'ভারত যদি কোনো একতরফা ব্যবস্থা নেয়, তবে এর যথাযথ জবাব দেওয়া হবে। পাকিস্তান তার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত।'
দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনার নতুন ঢেউ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরণের গোলাগুলি এবং সামরিক উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির জন্য মারাত্মক হুমকি। দুই দেশের মধ্যে যে কোনো সীমিত সংঘর্ষ দ্রুত বিস্তৃত আকার নিতে পারে, কারণ দু'দেশের কাছেই রয়েছে বিপুল পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানকে 'সর্বোচ্চ সংযম' দেখানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রাখছে।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিন ফেয়ার বলেন, "কাশ্মীরে যে কোনো নতুন সহিংসতা ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু করতে পারে। উভয় পক্ষের উচিত আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমন করা।"
কাশ্মীরের পরিস্থিতি আরও কোন দিকে মোড় নেয় তা এখন সময়ই বলে দেবে। তবে পর্যটক হত্যাকাণ্ড, নিয়ন্ত্রণরেখায় টানা সংঘর্ষ, এবং পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ফের একটি বড় সংকটের দিকে এগোচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সামরিক উত্তেজনার পাশাপাশি কূটনৈতিক চাপও বাড়ছে। এই সংকটের শেষ কোথায়—তা এখন দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ