
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর অব্যাহত হামলায় মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হলো। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুসারে, রোববার (২৭ এপ্রিল) মাত্র একদিনের মধ্যে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় আরও অন্তত ৫৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা তাদের এক প্রতিবেদনে গাজার মেডিকেল সূত্রের বরাতে এই মর্মান্তিক তথ্য জানিয়েছে।
মেডিকেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণ — সর্বত্র নির্বিচারে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। এসব হামলায় বহু আবাসিক ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও বহু মানুষ আটকে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক হামলার ভয়াবহতা অতীতের অনেক অভিযানের তুলনায়ও বেশি প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। আহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। সীমিত চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল ব্যবস্থার কারণে অনেক আহতকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মানবিক সংস্থাগুলো বারবার আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত। ওইদিন দক্ষিণ ইসরাইলে হামলা চালিয়ে হামাসের যোদ্ধারা প্রায় ১,২০০ ইসরাইলিকে হত্যা করে এবং প্রায় ২৫১ জনকে জিম্মি করে নেয়। এর প্রতিশোধ নিতে সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।
টানা ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে চালানো হামলায় গাজায় মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর চাপের মুখে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি থেকে একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় উভয় পক্ষ। সেই যুদ্ধবিরতি দুই মাসও টেকেনি। গত ১৮ মার্চ থেকে আবারও গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ।
দ্বিতীয় দফার এই অভিযানেও পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়নি- বরং আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নতুন করে শুরু হওয়া হামলায় ইতিমধ্যে দুই হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ। ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া বহু মানুষকে উদ্ধারের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেই, যার ফলে মৃতের সংখ্যা বাড়তেই থাকছে।
অন্যদিকে, ইসরাইলি বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তারা মূলত হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্য করেই অভিযান পরিচালনা করছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন— অধিকাংশ হামলাই আবাসিক এলাকা, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল ও বাজার targeting করে চালানো হচ্ছে।
গাজা এখন কার্যত এক খোলা কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, পানি নেই— চরম মানবিক সংকটের মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অবরুদ্ধ গাজাবাসী। জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠন পরিস্থিতিকে "চরম মানবিক বিপর্যয়" হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবরুদ্ধ গাজায় যুদ্ধের অবসান না হলে আগামী দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে আরও জোরালো আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে, মানবিক বিরতি বা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা সম্পর্কে ইসরাইলি নেতৃত্ব এখনও অনড় মনোভাব প্রকাশ করেছে। আইডিএফের তরফ থেকে বলা হয়েছে, হামাস সম্পূর্ণ নির্মূল না করা পর্যন্ত তারা অভিযান অব্যাহত রাখবে। অন্যদিকে হামাসও দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।
এই পরিস্থিতিতে গাজায় প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ বাড়লেও, কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান নয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ