
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে ভয়াবহ বন্দুক হামলায় ২৬ জন প্রাণ হারানোর ঘটনায় নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক। এমন এক সময়, যখন দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে সামান্য উত্তেজনাও ভয়াবহ সংঘাতের দিকে গড়াতে পারে, তখন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। আঙ্কারা থেকে তিনি বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই অঞ্চলের যেকোনো অস্থিরতা শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, পুরো বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) তুরস্কের মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এরদোগান বলেন, ‘পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চলমান উত্তেজনা দ্রুত প্রশমিত হওয়া জরুরি। আমরা চাই, দুই দেশই দায়িত্বশীল আচরণ করুক এবং উত্তেজনা যাতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম না দেয়, সেদিকে নজর দিক।’
এরদোগান তার বক্তব্যে সরাসরি কোনো পক্ষের প্রতি সমর্থন জানাননি। বরং কূটনৈতিক সৌজন্য রক্ষা করে উভয়পক্ষকে সংযত আচরণের আহ্বান জানান। তুরস্কের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় অংশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যারা চায়, দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ শান্তিপূর্ণভাবে উত্তেজনা নিরসন করুক।
হামলার পর থেকেই চরম উত্তেজনা
গত মঙ্গলবার জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগাঁও এলাকায় বন্দুকধারীদের এক হামলায় ২৫ জন ভারতীয় ও ১ জন নেপালি নাগরিক নিহত হন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, কাশ্মীরে এত বড় প্রাণঘাতী হামলা সাম্প্রতিক সময়ে খুব কমই ঘটেছে। হামলার পরপরই ভারতজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এবং কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তানকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
ভারত সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও শীর্ষ নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, পাকিস্তানকে ‘উচিত জবাব’ দিতে সামরিক বিকল্পও বিবেচনায় রয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর মোতায়েন জোরদার করা হয়েছে। কূটনৈতিকভাবেও পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মহলে চাপে রাখার পরিকল্পনা শুরু হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া: প্রস্তুতি এবং সতর্কতা
অন্যদিকে ইসলামাবাদ থেকে ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেছি। কারণ এখন সামরিক আক্রমণ আসন্ন। এই পরিস্থিতিতে আমরা কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পাকিস্তান ভারতের সম্ভাব্য সামরিক অভিযান ঠেকাতে এবং প্রয়োজন হলে পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আসিফের এই মন্তব্য আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে যখন দুই দেশের মধ্যে অতীতে কার্গিল যুদ্ধ (১৯৯৯) বা সীমান্ত সংঘর্ষের মতো ভয়াবহ ইতিহাস রয়েছে, তখন এমন বিবৃতি নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দেয়।
কাশ্মীর নিয়ে ঐতিহাসিক বিরোধ: আগুনের নিচে চাপা আতর
কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশ দুবার পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধে জড়িয়েছে। তৃতীয়বার যুদ্ধের সম্ভাবনা বরাবরই ছিল, বিশেষ করে যখন এই অঞ্চল দুই দেশের জন্যই জাতীয় মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারত কাশ্মীরকে তার ‘অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে বিবেচনা করে। অন্যদিকে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবির পক্ষে সোচ্চার। ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে মদত দেয়। তবে পাকিস্তান এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ
কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির খবরে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা দুই দেশকেই শান্ত থাকার এবং উত্তেজনা প্রশমনে সংলাপ চালানোর আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশের মধ্যে কোনো সামরিক সংঘাত শুধু স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং শরণার্থী সমস্যা ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: এখনো সময় আছে সংলাপের
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা মনে করছেন, এখনো ভারত ও পাকিস্তানের সামনে সংলাপের সুযোগ রয়েছে। তবে উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সংযম দেখাতে হবে এবং জনমতকে শান্ত রাখতে হবে।
নতুন দিল্লিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. প্রণব মুখার্জি বলেন, "এমন ক্রান্তিকালে নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো উত্তেজনা উসকে না দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। উভয় দেশের জনগণের শান্তি এবং উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।"
অন্যদিকে ইসলামাবাদভিত্তিক বিশ্লেষক ড. রেহান আজম বলেন, "কাশ্মীর ইস্যু কখনো শক্তির মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়। সংলাপই একমাত্র পথ। যুদ্ধ শুরু করা সহজ, কিন্তু থামানো কঠিন।"
এরদোগানের ভূমিকা: মধ্যস্থতার ইঙ্গিত?
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এর আগে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংকটে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ২০২2 সালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও তিনি খাদ্যশস্য চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন। ফলে অনেকেই মনে করছেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায়ও এরদোগান কোনো সময় মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিতে পারেন।
তবে এখন পর্যন্ত এরদোগান শুধুমাত্র শান্তির আহ্বান জানিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন। কোনো সরাসরি উদ্যোগের ঘোষণা দেননি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ