
ছবি: সংগৃহীত
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার শুল্কযুদ্ধ বিশ্বব্যবস্থাকে এক অস্থির ও উত্তেজনাপূর্ণ বাণিজ্যিক লড়াইয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০২5 সালের শুরু থেকে এই সংঘাত নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় চীনা পণ্যের ওপর ব্যাপকহারে শুল্ক আরোপ করেন। গত ৯ এপ্রিল ট্রাম্প চীনের আমদানি পণ্যের ওপর ‘পারস্পরিক শুল্ক’ স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি এসব পণ্যের শুল্কহার বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করেন। এর পাল্টা জবাবে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে।
ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্যিকভাবে শোষণ করছে। তার মতে, উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে দেশীয় শিল্প রক্ষা, কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধার এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন সম্ভব। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের বড় একটি অংশ এই কৌশলকে কার্যকর বলে মনে করছেন না।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে – কে আগে নতি স্বীকার করে এবং কে তার অবস্থানে অনড় থাকে। এদিকে এই শুল্কযুদ্ধ শুধু দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ছে বৈশ্বিক বাণিজ্য, কৃষি উৎপাদন, ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য এবং সাধারণ জনগণের জীবনমান পর্যন্ত।
আলোচনা ও রাজনৈতিক বক্তব্যের অসঙ্গতি
শুল্ক আরোপের ঘোষণার কিছুদিন পর ট্রাম্প দাবি করেন, চীনের সঙ্গে একটি “ন্যায্য চুক্তি” নিশ্চিত করার ব্যাপারে আলোচনা চলছে এবং শিগগিরই চীনের ওপর শুল্ক “উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস” পাবে। তবে এই বক্তব্যের একদিন পরেই চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ দাবিকে “ভিত্তিহীন” বলে প্রত্যাখ্যান করে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হে ইয়াদং স্পষ্ট করে বলেন, “চীন-মার্কিন অর্থনৈতিক আলোচনা এখন চলমান নয়।” তবে তিনি দরজা খোলা রাখার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, বেইজিং আলোচনায় ফিরে যেতে প্রস্তুত রয়েছে।
এই অসঙ্গতিপূর্ণ বার্তাগুলো শুধু দুই দেশের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে না, বরং বিশ্ববাজার ও বিনিয়োগকারীদের মনোভাবেও প্রভাব ফেলছে।
শুল্কের সরাসরি প্রভাব মার্কিন কৃষিতে
শুল্কযুদ্ধের সরাসরি প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে মার্কিন কৃষিখাতে, বিশেষ করে সয়াবিন রপ্তানিতে। মার্কিন কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণার পরবর্তী সপ্তাহে সয়াবিন রপ্তানি আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। শুধু চীনে রপ্তানি ৬৭ শতাংশ হ্রাস পায়, যা এই পণ্যের অন্যতম প্রধান বাজার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষকদের ওপর এই চাপ দীর্ঘমেয়াদে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। সুইজারল্যান্ডের নিউচাটেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ পিয়েরগিউসেপ্পে ফরচুনাটো সতর্ক করে বলেন, “চীনের প্রতিশোধমূলক শুল্ক মার্কিন কৃষকদের জন্য বিধ্বংসী প্রভাব ফেলতে পারে। কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হতে পারেন।”
চীনের ওপর চাপ, কিন্তু বিকল্প প্রস্তুত
যদিও মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চীনের অর্থনীতির ওপরও চাপ তৈরি হয়েছে, তবে বেইজিং তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গোল্ডম্যান শ্যাক্স-এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মার্কিন শুল্কের ফলে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২.৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। তবুও চীনা নেতারা আত্মবিশ্বাসী যে দেশীয় উৎপাদন ও বিকল্প আমদানির উৎস দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ঝাও চেনজিন জানান, চীন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির সক্ষমতা রাখে। তার মতে, দেশীয় উৎপাদনের সক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান কি হুমকিতে?
ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপ, জাপান এবং ব্রিটেনের মতো মিত্রদেরও শুল্ক চাপের মধ্যে ফেলেছে। এদের অনুরোধ করা হয়েছে যেন তারা চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করে। তবে এই অনুরোধ খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ইউরোপীয় কমিশন সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে নয়।
ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভসও বলেছেন, “চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তার সঙ্গে জড়িত না হওয়া অবাস্তব ও ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত হবে।”
চীন এখন এমন এক বাণিজ্যিক শক্তি হয়ে উঠেছে, যার ওপর বহু উন্নয়নশীল দেশ নির্ভরশীল। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলো চীনা পণ্যের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় ট্রাম্পের শুল্কনীতি বিশ্বব্যাপী সমর্থন পাচ্ছে না।
রাজনৈতিক ফলাফল কী হতে পারে ট্রাম্পের জন্য?
চীনা নেতৃত্বের জন্য কোনও নির্বাচনী চাপ না থাকলেও ট্রাম্পকে সামনে দেখতে হচ্ছে আসন্ন নির্বাচন। অর্থনৈতিক সংকট ও কৃষিখাতে ক্ষতির কারণে তার জনপ্রিয়তা কমছে। ‘ইকোনমিস্ট-ইউগভ’ এবং ‘রয়টার্স-ইপসোস’-এর জরিপে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন নাগরিকরা মনে করছেন ট্রাম্পের নীতিগুলো তাদের ক্ষতিই করছে।
৩১ মার্চের জরিপে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতি জনসমর্থন নেমে এসেছে মাত্র ৩৭ শতাংশে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির জন্য এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
এই শুল্কযুদ্ধের কোন পক্ষ শেষ পর্যন্ত ‘জয়ী’ হবে, তা নির্ধারণ করবে সময়। তবে আপাতত এটি স্পষ্ট যে, বিশ্বব্যবস্থা একটি অস্থির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি শুল্ক হার, প্রতিটি রাজনৈতিক বিবৃতি—এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ