ছবি : সংগৃহীত
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও সাবেক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য ও কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মো. মতিউর রহমানের নামে চলতি সপ্তাহে মামলা হতে পারে এবং সেই সাথে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাদের পরিবারের অভিযুক্ত সদস্যদেরও নামে মামলা হতে পারে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, এর আগে ৩ বারে মতো বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এজন্য তাদের অর্থসম্পদকে অপরাধলব্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
একইভাবে দেশে সম্প্রতি ছাগলকাণ্ডে আলোচিত-সমালোচিত সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের যে তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে তাতে দেখা গেছে বৈধ আয়ের চেয়ে অস্বাভাবিক। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চাকরিজীবনে তিনি অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন।
সূত্র জানায়, দুদক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে গত ২২ এপ্রিল। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের তলবী নোটিশ পাঠায় হয় গত ২৮ মে। এর আগে গত ৪ মে তিনি সপরিবারে দেশ ত্যাগ করেন। বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে তাদের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিস্তারিত তদন্ত করেছে। এরপরই গণমাধ্যমে তাদের অস্বাভাবিক সম্পদের খবর প্রকাশ পায়।
গত ২৩ ও ২৬ মে আদালতের আদেশে বেনজীর, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদ, ব্যাংক হিসাব, শেয়ারসহ অন্যান্য সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়। তাদের নামে থাকা ৮৩টি দলিলে ৬২১ বিঘা জমি, গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দ, ৩৮টি ব্যাংক হিসাব ও তাদের মালিকানার কোম্পানি ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধের ওই আদেশ দিয়েছেন। ওই দুইদিনে বেনজীর ও তার পরিবারের পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৩৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়।
মতিউর রহমানের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা গেছে, নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ার অভিযোগে ২০০৮, ২০১৩ ও ২০২১ সালে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয় এবং তিনবারই অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে তাকে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়।
মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে সাইমুম অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি তিনি আত্মসাৎ করেন। তথ্য গোপন করে তিনি ‘জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস’ (অফিস-৩৪, গ্রীন রোড, নবাব ম্যানশনের পঞ্চম তলা)-এর সদস্য হয়ে ক্ষুদ্র ও অসচ্ছল ব্যবসায়ী কোটায় বাড্ডায় সরকারি ওয়াকফ এস্টেট সম্পত্তি থেকে একটি প্লট নিজ নামে দলিল করে নেন। সাইমুম অ্যাসোসিয়েটসের সম্পত্তি দখলের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। ভুক্তভোগী এনামুল হকের পরিবার ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে। ওই সংবাদ সম্মেলনে এনামুলের বাবা আব্দুস সালাম, মা রহিমা বেগম, বোন আসমা, ভাই রাশেদুল ও ইলিয়াস উপস্থিত ছিলেন। তারা অভিযোগ করেন, ১০৯ গ্রীন রোডে অর্কিড প্লাজায় এনামুল হকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেন মতিউর রহমান, তার ভাই নূরুল হুদা ও ক্যাশিয়ার হাফিজুর রহমান। মতিউরের ছোটভাইয়ের শ্যালক রফিকুল আলম জুয়েলের নেতৃত্বে এনামুলের গোডাউন লুট ও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। খবর পেয়ে র্যাব গিয়ে তাকে উদ্ধার করেছিল।
সূত্র জানায়, ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মতিউরের নামে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ রয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান। মতিউর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে অবাধে দুর্নীতি করে আসছেন। সব মিলিয়ে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
মতিউর রহমানের নামে আরও অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের ৭/এ সড়কের ৩৮৪ নং বাড়িতে স্ত্রীর নামে ৫০১ নং ফ্ল্যাট, একই ব্লকের ১ নং সড়কের ৫১৯ নং হোল্ডিংয়ে ৭ তলা বাড়ি, যার আনুমানিক দাম ৪০ কোটি টাকা।
প্রায় ৩০০ বিঘা জমিতে ময়মনসিংহের ভালুকায় রয়েছে জুতার ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরির চেয়ারম্যান তিনি নিজেই। ফ্যাক্টরিতে প্রায় ৪০০ শ্রমিক কাজ করেন।
মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে প্রথম অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয় ২০০০ সালের দিকে। তিনি ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে বেনাপোল বন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ছিলেন। সেই সময়ে তার বিরুদ্ধে বেপরোয়া ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দুদক তখন দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান ঝুলিয়ে রেখে ২০০৪ সালে অভিযোগের পরিসমাপ্তি ঘটায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষে এমবিএ করেন মতিউর। ১৯৯০ সালে চাকরি নেন পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনে। পরে ১৯৯৩ সালে ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘কাস্টমস ক্যাডার’ হিসেবে যোগ দেন। ২০১৫ সালে কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পান। মতিউর রহমান ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাবার্তা/এআর