ছবি : সংগৃহীত
দেশে সম্প্রতি ছাগলকাণ্ডে আলোচিত-সমালোচিত সাবেক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য ও কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মো. মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে নথিপত্র চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রোববার (৩০ জুন) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ চিঠি পাঠানো হয়।
দুদক সূত্রে জানা যায়, চিঠিতে মতিউর রহমান, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নাম উল্লেখ করে ঢাকা, নরসিংদী ও মুলাদির সাব রেজিস্ট্রার ও ভূমি অফিস, রাজউক, জয়েন্ট স্টক কোম্পানিসহ বিভিন্ন দপ্তরে পৃথক চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গত ৪ জুন মতিউরের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা হওয়ার পর কমিশনের পক্ষ থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য অনুসন্ধানে গত ২৩ জুন তিন সদস্যের টিম গঠন করে দুদক।
দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন বলেন, এনবিআরের সদস্য ড. মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে টিম গঠন করার পর তারা কাজ শুরু করেছে।
এর আগে পদ থেকে সরিয়ে মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকেও মতিউরকে অপসারণ করা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ার অভিযোগে ২০০৮, ২০১৩ ও ২০২১ সালে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয় এবং তিনবারই অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে তাকে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়।
মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে সাইমুম অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি তিনি আত্মসাৎ করেন। তথ্য গোপন করে তিনি ‘জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস’ (অফিস-৩৪, গ্রীন রোড, নবাব ম্যানশনের পঞ্চম তলা)-এর সদস্য হয়ে ক্ষুদ্র ও অসচ্ছল ব্যবসায়ী কোটায় বাড্ডায় সরকারি ওয়াকফ এস্টেট সম্পত্তি থেকে একটি প্লট নিজ নামে দলিল করে নেন। সাইমুম অ্যাসোসিয়েটসের সম্পত্তি দখলের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। ভুক্তভোগী এনামুল হকের পরিবার ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে। ওই সংবাদ সম্মেলনে এনামুলের বাবা আব্দুস সালাম, মা রহিমা বেগম, বোন আসমা, ভাই রাশেদুল ও ইলিয়াস উপস্থিত ছিলেন। তারা অভিযোগ করেন, ১০৯ গ্রীন রোডে অর্কিড প্লাজায় এনামুল হকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেন মতিউর রহমান, তার ভাই নূরুল হুদা ও ক্যাশিয়ার হাফিজুর রহমান। মতিউরের ছোটভাইয়ের শ্যালক রফিকুল আলম জুয়েলের নেতৃত্বে এনামুলের গোডাউন লুট ও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। খবর পেয়ে র্যাব গিয়ে তাকে উদ্ধার করেছিল।
দুদক সূত্র জানায়, ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মতিউরের নামে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ রয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান। মতিউর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে অবাধে দুর্নীতি করে আসছেন। সব মিলিয়ে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
মতিউর রহমানের নামে আরও অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের ৭/এ সড়কের ৩৮৪ নং বাড়িতে স্ত্রীর নামে ৫০১ নং ফ্ল্যাট, একই ব্লকের ১ নং সড়কের ৫১৯ নং হোল্ডিংয়ে ৭ তলা বাড়ি, যার আনুমানিক দাম ৪০ কোটি টাকা।
প্রায় ৩০০ বিঘা জমিতে ময়মনসিংহের ভালুকায় রয়েছে জুতার ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরির চেয়ারম্যান তিনি নিজেই। ফ্যাক্টরিতে প্রায় ৪০০ শ্রমিক কাজ করেন।
মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে প্রথম অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয় ২০০০ সালের দিকে। তিনি ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে বেনাপোল বন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ছিলেন। সেই সময়ে তার বিরুদ্ধে বেপরোয়া ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দুদক তখন দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান ঝুলিয়ে রেখে ২০০৪ সালে অভিযোগের পরিসমাপ্তি ঘটায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষে এমবিএ করেন মতিউর। ১৯৯০ সালে চাকরি নেন পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনে। পরে ১৯৯৩ সালে ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘কাস্টমস ক্যাডার’ হিসেবে যোগ দেন। ২০১৫ সালে কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পান। মতিউর রহমান ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাবার্তা/এআর