ছবি : সংগৃহীত
সীমান্ত প্রতিবেশী বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক টানাপোড়েন প্রকাশ্যে এসেছে। সম্মিলিত সনাতন জাগরণী মঞ্চের মুখপাত্র ও ইসকন নেতা চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে দু-দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির বিষয় সামনে এসেছে। যার চূড়ান্ত চিত্র দেখা দেয় আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার পর। তবে এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পেছনে সাবেক স্বৈরাচার সরকারের দোষরদের হাত রয়েছে বলে মত সচেতন মহলের।
ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। রাজধানীতে বিক্ষোভ-মিছিল থেকে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নতজানু মনোভাব পরিহার করে ভারতের সঙ্গে শুধু প্রতিবেশীসুলভ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখারও দাবি উঠেছে এসব কর্মসূচি থেকে। বাংলাদেশ সরকারের কড়া প্রতিবাদের পাশাপাশি বিক্ষোভ-সমাবেশ করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-সংগঠন।
এ অবস্থায় দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আলোচনার জন্য নিজেদের পররাষ্ট্র সচিবকে ঢাকায় পাঠাচ্ছে ভারত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস গতকাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি আলোচনার জন্য আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। গত আগস্টে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিনিয়র কোনো ভারতীয় কর্মকর্তার ঢাকায় এটিই প্রথম সফর হতে চলেছে।
হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, উভয় দেশের কেউই এখনো এই সফরের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে বিক্রম মিসরি সম্ভবত আগামী ১০ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক আলোচনার জন্য বাংলাদেশে আসবেন। উভয় দেশের রাজধানীতে তথা ঢাকা ও দিল্লিতে বিক্রমের সফরের প্রস্তুতির বিষয়ে জানা গেছে।
এরই মধ্যে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনাকে ভিয়েনা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারতের দুঃখ প্রকাশকে ইতিবাচক উল্লেখ করে তারা বলছেন, হামলার জবাবে জোরালো প্রতিবাদ বাংলাদেশের কূটনীতিকে শক্ত অবস্থানে নিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন সংকটের চূড়ান্ত সীমানায় রয়েছে বলেও মত তাদের।
ভারতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই এমন ঘটনা পরিকল্পিত মনে করে ঢাকা। প্রথমে প্রতিবাদলিপি ও পরে হাইকমিশনারকে জরুরি তলব করে প্রতিবাদ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে সব ধরনের ভিসা ও কনস্যুলার সেবা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগরতলার বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন। হামলার জবাবে জোরালো প্রতিবাদ করায় ক‚টনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যা ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। তবে এ ঘটনায় ভারতের দুঃখ প্রকাশ ইতিবাচক।
গতকাল বাংলাদেশ সরকারের দুই উপদেষ্টা ফেসবুক পোস্টে চলমান ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান এবং ভারতের আচরণের তীব্র নিন্দা করেছেন। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ভারতের শাসকগোষ্ঠী বিভেদের রাজনীতি ও বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যাচারে লিপ্ত রয়েছে। ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো দুই দেশের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি চায় না। সংখ্যালঘু নিপীড়নের ধুয়া তুলে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টায় রয়েছে দিল্লি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা উপলব্ধি করা এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থান এবং ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া। ভারতকে ভাবতে হবে, এটা ৭৫-পরবর্তী পরিস্থিতি নয়।
মিথ্যা বলে বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভারত অহেতুক মিথ্যা বলে বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আগামীর সময় পার করতে হবে। আমরা আশা করছি, ভারত অতীতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে যে ভুল করেছে সেটাকে তারা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। পাশাপাশি বর্তমানে যে কার্যকলাপ করেছে তা বন্ধ করবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক মো. শহীদুজ্জামান বলেন, আমার মনে হয় অলরেডি আমরা পিক অফ দ্য ক্রাইসিস মোমেন্টে পৌঁছে গেছি। কারণ এর চেয়ে খারাপের দিকে যাওয়া মানে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া এবং সেটা বাংলাদেশও চাইবে না। ভারতও চাইবে না। বাংলাদেশও কিন্তু পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে ভিসা ইস্যু করা বন্ধ, অফিস আপাতত বন্ধ। কাজেই এই যে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ বাংলাদেশ নিয়েছে এটা ভারতের জন্য যথেষ্ট অপমানজনক এবং এই অপমানটা তারা অর্জন করেছে।
দুই দেশের সম্পর্ক এমন সংকটে পৌঁছানোর পেছনে ভারতের কিছু মিডিয়াকেই অনেকটা দায় দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনারও ষড়যন্ত্র থাকতে পারে এতে। পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ার কথা শুনলে মনে হয় যেন যেকোনো সময় যুদ্ধই লেগে যাবে। আমার মনে হয় এই পুরো বিষয়টাই নাটক। আর এখানে অর্থের লেনদেন হচ্ছে। আমাদের এখানকার বিগত শাসকগোষ্ঠী, তারা প্রচুর অর্থের ছড়াছড়ি করেছে। এবং সে অর্থের একটা বড় অংশ এই ইন্ডিয়ার মিডিয়ার পেছনে খরচ করা হয়েছে।
১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের চুক্তি অনুযায়ী, ভিনদেশের দূতাবাসের জন্য জায়গা বরাদ্দের পাশাপাশি সেখানে কর্মরত কূটনীতিকদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় দেশগুলোকে। সেখানে ভারত চুক্তির লঙ্ঘন করেছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতে যেটা ঘটেছে সেটা নিশ্চিতভাবেই ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। তার কারণ হলো ভিয়েনা কনভেনশনে পরিষ্কার করে বলা আছে, কোনো স্বাগতিক দেশ অন্য দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং সম্পদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। সেখানে যদি সে সুরক্ষা না থেকে থাকে তাহলে দায়িত্বটা তাদের ঘাড়েই পড়ে। আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা বিভ্রান্তি, মিডিয়াতে এক ধরনের অপপ্রচার চলছে। এক ধরনের অতিরঞ্জন মিথ্যাচার চলছে। এটা যদি ক্রমাগত চলতে থাকে তাহলে কিন্তু এ ধরনের ঘটনা আবার ঘটার একটা আশঙ্কা থাকবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে উভয় দেশকে ছাড় দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রয়োজন মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেছেন, চলমান সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক সমাধানই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। মনে রাখতে হবে, আমাদের সঙ্গে কেউ বাড়াবাড়ি করলে সেটা ঠান্ডা মাথায় নিয়মমাফিক সমাধানের পথেই এগোতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমআর