ফটো কোলাজ: বাংলাবার্তা
রেলসেবা সহজ করতে ও বিরম্ভনা কমাতে শুরু হয় অনলাইনে টিকিট বিক্রি। সরকারি এ পরিবহনে বছরে টিকিট বরাদ্ধ থাকে ও কোটি। বিক্রি হয় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। এর মধ্যে অনলাইনে টিকিট বিক্রি বছরে দেড় কোটি। অনলাইনে প্রতিটির জন্য সার্ভিস চার্জের নামে অতিরিক্ত ২০ টাকা কেটে নেওয়া হয়। সে হিসেবে গ্রাহকের কাছ থেকে কেটে নেওয়া টাকার পরিমাণ বছরে ৩০ কোটি। এই টাকার কোনো অংশই পায় না রেলওয়ে। পুরোটাই চলে যায় 'সহজের' পকেটে। অথচ চুক্তিপত্র অনুযায়ী প্রতি টিকিটের বিপরীতে ২৫ পয়সা করে নেওয়ার কথা ছিল।
আজ রবিবার (২২ ডিসেম্বর) এই তথ্য প্রকাশ করেছে দৈনিক ‘আমার দেশ’।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদন বলছে, অনলাইনে টিকিট বিক্রির জন্য ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারিতে সহজের সঙ্গে চুক্তি করে রেল। সেই থেকে দু'বছর হতে চলল, কিন্তু চুক্তির বিষয়ে জানে না কেউ। কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তার কাছে নেই এ বিষয়ে কোনো তথ্য। আমার দেশের এ প্রতিবেদক নানাভাবে চেষ্টা করেও রেলের সঙ্গে সহজের চুক্তিপত্রের বিষয়ে কোনো তথ্য পাননি। রেলপথ মন্ত্রণালয় কিংবা সহজ প্রতিষ্ঠানের কেউ এ সংক্রান্ত নথি দিতে রাজি হয়নি। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের কর্মকর্তারাও এক বছরে কয়েকবার চিঠি দিয়েও এ চুক্তিপত্র পায়নি। চুক্তিপত্রে কী আছে সেটিও জানেন না রেলের কর্মকর্তারা।
‘সহজের সঙ্গে রেলের চুক্তি হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বেশকিছু শর্তের বিষয়ে খোলাসা করেছিলেন। এর মধ্যে একটি হলো- অনলাইনে রেলের প্রতি টিকিটের বিপরীতে ২৫ পয়সা করে সার্ভিস চার্জ কেটে নেওয়া। কিন্তু অনুসন্ধানে ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের রঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনলাইনে প্রতি টিকিটের বিপরীতে সার্ভিস চার্জের নামে ২০ টাকা করে কেটে নেওয়া হচ্ছে। এই প্রতিবেদক নিজেও টিকিট কেটে ২০ টাকা চার্জ দিতে বাধ্য হয়েছেন।’
‘সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার একটি স্নিগ্ধা টিকিটের দাম ৭৪৩ টাকা। অনলাইনে যখন কোনো যাত্রী টিকিট কাটবেন তাকে ভ্যাটসহ পুনতে হবে ৮৫৫ টাকা। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ নামে আরও ২০টাকা কেটে নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে একটি টিকিটের দাম ৮৭৫ টাকা। একটি সূত্র জানায়, এই ২০ টাকার মধ্যে ৪ টাকা যায় সরকারি সংস্থা বিটিআরসিতে, ৪ টাকা যায় মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেমে আর বাকি ১২ টাকা যাচ্ছে সহজ প্রতিষ্ঠানের কাছে। বছরে অনলাইনে দেড় কোটির টিকিট থেকে সার্ভিস চার্জ নামে ৩০ কোটি টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। এ হিসাবেও বছরে ১৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত নিচ্ছে সহজ।’
‘রেলওয়ে জানায়, রেলওয়েতে বছরে বিক্রিযোগ্য টিকিট বরাদ্দ থাকে কমবেশি ৫ কোটি ১০ লাখ। রেলমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৩ সালে রেলওয়ে টিকিট বিক্রি করেছে প্রায় ৩ কোটি ৪৫ লাখ। আর অনলাইনে টিকিট বিক্রি হয়েছে দেড় কোটি। সহজ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দায়িত্ব নিয়েছে। এই দুই বছরে সার্ভিস চার্জের নামে সহজ হাতিয়ে নিয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। সহজের আগে রেলের টিকিট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ছিল সিএনএস নামে একটি সংস্থা। তারা ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেটিং সিস্টেমে অনলাইন যুগের সূচনা করে। তাদের নিজয় তৈরি অ্যাপের মাধ্যমে ই-টিকেট বিক্রি শুরু করে রেলওয়ে। যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রতিদিন মোট টিকিটের ৫০ শতাংশ টিকেট দেওয়া হয় অনলাইনে। আর এ ৫০ শতাংশ টিকিটকে পুঁজি করে প্রতিমাসে সার্ভিস চার্জের নামে তারা হাতিয়ে নিয়েছিল ৫০ লাখ টাকার মতো। তবে অ্যাপ চালু হওয়ার পর প্রতি মাসে একই টিকেট বিক্রি করে রেলওয়ের কোষাগারে মাত্র ১০. কোটি টাকা করে জমা দিত সিএনএস। প্রতিটি অনলাইন টিকিটের থেকেও অতিরিক্ত ২০ টাকা চলে যেতো সংস্থাটির কাছে। এমব দুর্নীতির কারণে কাজ হারায় সিএনএস।’
‘২০২২ সালে ফেব্রুয়ারিতে সহজের সঙ্গে চুক্তি করেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তখন মন্ত্রী বলেছিলেন, সিএনএস প্রতিটি টিকিট বিক্রির জন্য রেলের কাছ থেকে দুই টাকা ৯৯ পয়সা পেত। সহজ নেবে মাত্র ২৫ পয়সা। কিন্তু সহজ মাত্র ২৫ পয়সায় কীভাবে টিকিট বিক্রি করবে- তা রেলওয়ে কিংবা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।’
‘রেলসূত্রে জানা গেছে, টিকিট বিক্রির রেলের ওয়েবসাইট ও অ্যাপ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ পাঁচ বছরে ২৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা আয় হবে প্রাক্কলন করেছে সহজ। ২০ কোটি টিকিট বিক্রির জন্য রেলের কাছ থেকে নেবে পাঁচ কোটি টাকা। এ হিসাবে টিকিট প্রতি ১ টাকা ৫১ পয়সা আয় হবে। সিএনএস পাঁচ বছরে ২০ কোটি টিকিটের জন্য ২৪ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রতি টিকিটের জন্য ১ টাকা ২০ পয়সা চেয়েছিল। রেলের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সহজকে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত করে। রেল পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের অফিসে গেলে, তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) এএম সালাহ উদ্দীনকে তিন দিন চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।’
‘এই বিষয়ে সহজের নির্বাহী পরিচালক সুদিপ দেবনাথ দাবি করেন, প্রতিটি অনলাইন টিকিটের সার্ভিস চার্জের ২০ টাকা থেক তারা পান ৬ টাকা। বাকি ১৬ টাকা মোবাইল ব্যাংকি কোম্পানিগুলো কেটে নেয়। কিন্তু কোন মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি কীভাবে এই টাকা কেটে নেয়- এ বিষয়ে তার কাছে কোনো উত্তর নেই। রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, চুক্তি অনুযায়ী কাউন্টারে প্রতি টিকিটের বিপরীতে সহজ পাবে ২৫ পয়সা। অনলাইন টিকিটে সার্ভিস চার্জের অতিরিক্ত ২০ টাকা মোবাইল কোম্পানি ও সহজ পায়। কাউন্টারে টিকিট আমরা ওপেন রেখেছি। যাত্রী চাইলে অনলাইন অফলাইন দুই জায়গা থেকেই কাটলে পারবে।' তবে তার কাছে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি ও সহজের ২০ টাক কেটে নেওয়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই।’