
ফাইল ছবি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে আরাকান আর্মির ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ নিষিদ্ধের ঘোষণা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতির পথ আরও কঠিন করে তুলবে, একই সঙ্গে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এ সংকটের মাঝেও কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সাম্প্রতিক কক্সবাজার সফর। তার এই সফর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ ফেরাতে পারে, যা মানবিক সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপও বৃদ্ধি করতে পারে।
রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংকট ও মানবিক সহায়তার চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে কক্সবাজার ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমে যাওয়ার ফলে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক বরাদ্দ ১২.৫০ ডলার থেকে কমিয়ে মাত্র ৬ ডলারে নামিয়ে এনেছে।
‘ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা নে স্যান লুইন দ্য ডিপ্লোম্যাটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরের ফলে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কিছুটা হলেও বাড়তে পারে। তবে ডব্লিউএফপি যদি বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী চরম পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।
প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর বিষয়টি মূলত দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করেন লুইন। রাখাইনে বর্তমানে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, বরং রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি হ্রাস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্বের স্বপ্নও আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এদিকে, সংঘাতের কারণে নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমান্ত পেরিয়ে আসার জন্য তারা বিভিন্ন নৌচালক ও দালালদের ঘুষ দিচ্ছে। লুইন বলেন, রাখাইনে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ায় অনেক রোহিঙ্গা নতুন করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
সমাধান কী?
নে স্যান লুইন মনে করেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ, মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সদিচ্ছার সমন্বয় প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়, তাই তাদের ক্ষমতায়ন প্রয়োজন।
রোহিঙ্গাদের স্বাবলম্বী করতে তিনি কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন:
- নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা
- কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা
- শরণার্থী ক্যাম্পে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উদ্যোক্তা কার্যক্রম চালু করা
- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উপযুক্ত বেতনে চাকরির ব্যবস্থা করা
তবে বর্তমান আইন অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে চাকরি করতে পারেন না। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিরোধিতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণেও এই সুযোগ সৃষ্টি করা কঠিন।
বাংলাদেশের উদ্বেগ ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সম্ভাবনা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ রয়েছে। লুইন বলেন, “যদি সরকার আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করতে পারে, তবে এ উদ্বেগ কমে আসবে।”
তিনি আরও মনে করেন, এটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর না করলেও মিয়ানমারের গণহত্যার শিকার এই জনগোষ্ঠীর অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
ভারত ও চীনের মতো শক্তিধর প্রতিবেশী দেশগুলোর কূটনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয় বলে মত দেন লুইন। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তাহলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শরণার্থী সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয়
আইসিসি (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) ও আইসিজে (আন্তর্জাতিক বিচার আদালত)-কে আরও কার্যকরভাবে মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে, যাতে দেশটি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
এদিকে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর প্রতি কার্যকর মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান লুইন। তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এখনই উপযুক্ত সময়, নতুবা এটি দীর্ঘমেয়াদে আরও জটিল হয়ে উঠবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ