
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশে নিয়ে গেছে, তখন অনেকেই ভাবছিলেন পাল্টা কড়া জবাব আসবে ঢাকা থেকে। কিন্তু চীনের মতো ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ বাধিয়ে না দিয়ে, বাংলাদেশ সরকার ঠিক করেছে আলোচনার পথেই সমাধান খুঁজবে। তারই অংশ হিসেবে মার্কিন পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর বদলে কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এই অবস্থান নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একদিকে কূটনৈতিক নমনীয়তা দেখাতে চাচ্ছে, অন্যদিকে চেষ্টাও করছে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক ধরে রাখতে। তবে এ পদক্ষেপে আছে কিছু স্পষ্ট সুবিধা, তেমনি আছে ঝুঁকির দিকও।
কোন পণ্যে শুল্ক কমানোর চিন্তা?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) মিলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিযোগ্য প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব তৈরি করেছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো হলো:
জেনারেটর ও এর যন্ত্রাংশ
ভাল্ব ও ইলেকট্রিক আইটেম
গরুর মাংস ও অ্যাগ্রো পণ্য
ডায়াগনস্টিক যন্ত্রপাতি
সফটওয়্যার ও আইটি পণ্য
মেশিনারিজ, মোটর গাড়ির যন্ত্রাংশ
হ্যান্ড ডায়াফ্রাম ভাল্ব, ইউপিএস-আইপিএস
পারফিউম, সাবান, ডিটারজেন্ট
মোবাইল ফোন, ভিডিও রেকর্ডার, এক্স-রে টিউব
এবং অন্যান্য বিলাসদ্রব্য
এসব পণ্যের বর্তমান শুল্কহার ২৬ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে হলেও প্রস্তাবিত ছাড়ের হার এখনো নির্ধারিত হয়নি। সম্ভাব্য কমানো হার গড়ে ৫ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা কতটা বাস্তব?
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ২২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে, যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ হাজার ১০ কোটি টাকা।
এনবিআর হিসাব করছে, যদি সব পণ্যে পূর্ণাঙ্গ শুল্কছাড় দেওয়া হয়, তাহলে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ১০ কোটি টাকা। যদিও এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান মনে করেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির বিপরীতে আমরা যে শুল্ক আদায় করি তা খুবই সামান্য। শুল্ক কমালে প্রভাব পড়বে না।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতটা না রাজস্ব ক্ষতি, তার চেয়ে বেশি শঙ্কা দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার।
বিশ্ব বাণিজ্যনীতি ও চুক্তির বাধা
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো একক দেশের জন্য আলাদা ট্যারিফ রেট নির্ধারণ করা যায় না, যদি না সেই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি (FTA বা PTA) থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো চুক্তি নেই।
এনবিআরের সাবেক সদস্য আব্দুল মান্নান পাটোয়ারী বলেন, “চুক্তি না থাকলে কোনো এক দেশের জন্য রেট কমানো যায় না। তবে সরকার চাইলে এসআরও জারি করে নির্দিষ্ট পণ্যের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে পারে।”
এক্ষেত্রে সরকার সীমিত আকারে শুল্কছাড় দিয়ে আলোচনার দরজা খুলতে চায়। লক্ষ্য—যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি খাতে শুল্ক কমানোর অনুরোধ জানানো।
বাণিজ্য ভারসাম্য ও আসল সংকট
বর্তমানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বছরে গড়ে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যার ৯০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি মাত্র ২.২ বিলিয়ন ডলার, ফলে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৬.২ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতিই যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্বেগ।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশ তাদের পণ্যে গড়ে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে, যদিও এনবিআর বলছে এটি মাত্র ৫ শতাংশের বেশি নয়।
বিনিয়োগ ও স্থানীয় শিল্পের সামনে চ্যালেঞ্জ
শুল্ক ছাড়ের এই পদক্ষেপে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদন শিল্পখাতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করে মোবাইল উৎপাদন করছে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে, তেমনি মোবাইলের দামও কমেছে।
যদি মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমানো হয়, তাহলে আইফোনসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসপণ্য আমদানি বাড়তে পারে—যা স্যামসাংয়ের মতো বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগ-আনফ্রেন্ডলি সংকেত হতে পারে।
এছাড়া, সাবান, ডিটারজেন্ট, পারফিউম, টয়লেট সামগ্রীসহ পণ্যগুলো যদি সহজে ঢুকে পড়ে বাজারে, তাহলে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প চরম চাপে পড়বে।
নীতিনির্ধারকদের ভাবনা ও বিতর্ক
এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “বুঝে না বুঝে চাপের মুখে সব পণ্যে একই রেট করলে দেশীয় শিল্প ধ্বংস হবে।”
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “সব কূল রক্ষা সম্ভব নয়। গার্মেন্টস সেক্টর বাঁচাতে গেলে কোথাও না কোথাও আমাদের ছাড় দিতেই হবে।”
কৌশলী নমনীয়তা, নাকি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত?
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উদার বাণিজ্যনীতির পথ বেছে নেওয়া হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। শুল্ক ছাড়ের মাধ্যমে ঢাকা সংকট নিরসনের চেষ্টা করছে আলোচনার মাধ্যমে, যা আন্তর্জাতিকভাবে ‘পরিপক্ব কূটনৈতিক পদক্ষেপ’ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
তবে এই উদারতা কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে—যুক্তরাষ্ট্র কি পারস্পরিক ছাড় দেবে? এবং এই সিদ্ধান্তে দেশীয় শিল্প ও রাজস্ব কতটা বিপদে পড়বে?
জরুরি এখন একটি সুসমন্বিত, স্বার্থরক্ষাকারী, কৌশলী বাণিজ্যনীতি গ্রহণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ