
ফাইল ছবি
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের সঠিক অবস্থান এবং শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেওয়ার সিদ্ধান্তে দুদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ভারত যদি হাসিনাকে ফেরত না দেয়, তবে তা শুধুমাত্র দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে, বরং অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, ও কৌশলগত দিক থেকে ভারতের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে, যার মধ্যে বাণিজ্য, বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা, পানির বিষয় এবং আরও অনেক ইস্যু রয়েছে। ২০২৩-২৪ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৪ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় পণ্যের আমদানি, আর বাকি ১৪ বিলিয়ন ডলার ছিল ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ রয়েছে এবং বিপুলসংখ্যক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন। এছাড়া, ভারতের পর্যটন খাতে বাংলাদেশের জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশে অবদান রয়েছে।
এছাড়া, ভারতের নিরাপত্তার জন্যও বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেক এলাকা, যা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, বাংলাদেশে অবস্থিত। ভারত এই সংযোগ ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন, এবং শিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভারত চায় যে, বাংলাদেশ ও ভারত মধ্যবর্তী সম্পর্কের স্বাভাবিকতা বজায় থাকুক। সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং বিদ্যুৎ খাতেও ভারতীয় বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়তার মধ্যে রয়েছে। ভারতের দাবি, এই বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ হলে ভারতকে বড় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশের পক্ষেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা কাটানো অত্যন্ত জরুরি। পানি চুক্তি, তিস্তা চুক্তির নবায়ন এবং ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা সমাধান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়ন ও বৈষম্য কমানো বাংলাদেশের জন্য এক অপরিহার্য কাজ। এছাড়া, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোও বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ভারত এখনও তাকে ফেরত দেয়নি, তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তার ভারতে অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে, তা সম্পর্কের মধ্যে আরও জটিলতা তৈরি করবে। বিশেষত, যদি শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উস্কানি দেন, তা হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ তীব্র হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম শহিদুজ্জামান বলেন, "শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া ভারত সরকারয়ের জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হতে পারে, তবে তা সম্ভব নয়। কারণ, ভারত সম্ভাব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহায়ক হিসেবে হাসিনাকে ব্যবহার করতে চায়। তবে, সম্পর্ক আগের মতো থাকবে না, কারণ বাংলাদেশ তার পক্ষে করা চুক্তিগুলি মেনে চলবে না।"
একই সুরে সাবেক রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামসও বলেন, "শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে বাংলাদেশের স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এই পরিস্থিতি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।" তিনি আরও বলেন, "শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া, ভারতীয় সরকারের কথা বলার ধরন এবং ভিসা জটিলতাগুলো সম্পর্কের উন্নয়নের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. এম জসিম উদ্দিনও জানান, "এই সম্পর্কের মধ্যে বেশ কিছু কৌশলগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা যদি ভারতের সঙ্গে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেন বা উস্কানি দেন, তবে সেটা ভারতের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।"
এদিকে, বাংলাদেশও এই সম্পর্কের মধ্যে আরও স্বচ্ছতা এবং ইতিবাচক উন্নয়ন চায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজন, তাতে দুদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ আরও শক্তিশালী করতে হবে। এমনকি, সরকার শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য উভয় পক্ষকেই কিছু বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে।
এছাড়া, বাংলাদেশ বর্তমানে জাতীয় স্বার্থের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে, যেখানে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। ফলে, ভারতকে একটি শক্তিশালী, কার্যকর এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে যাতে উভয় দেশই সুষ্ঠু ও কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ