
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের সুতা ও বস্ত্র খাতে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানির সুবিধা বাতিল করে এনবিআর দেশের টেক্সটাইল খাতকে রক্ষা করতে একটি দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়ন করল। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, যা অবিলম্বে বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়।
এই প্রজ্ঞাপন অনুসারে, ভারত থেকে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারীসহ দেশের প্রধান পাঁচটি স্থলবন্দর দিয়ে আর সুতা আমদানি করা যাবে না। তবে সমুদ্রপথ ও অন্যান্য পথে সুতা আমদানি আগের নিয়মেই চালু থাকবে।
টেক্সটাইল মালিকদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ
এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে দেশের বস্ত্র ও সুতা শিল্পের স্বার্থ রক্ষা এবং শিল্পকারখানাগুলোর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা নিশ্চিত করার তাগিদ।
গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এনবিআরের কাছে দাবি তোলে যে, সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সস্তায় সুতা আমদানির কারণে দেশীয় সুতা উৎপাদকরা হুমকির মুখে পড়েছে।
বিটিএমএর মতে, স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আসার ফলে দাম এতটাই কম হয় যে দেশীয় শিল্পকারখানাগুলো সেই দামে টিকে থাকতে পারছে না। এর ফলে দেশি সুতা মিলগুলো ধীরে ধীরে উৎপাদন হ্রাসে বাধ্য হচ্ছে, অনেকে শ্রমিক ছাঁটাই করছে, এমনকি কেউ কেউ উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ ও ট্যারিফ কমিশনের ভূমিকা
বিটিএমএর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের মার্চে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এনবিআরকে একটি চিঠি পাঠায়। ওই চিঠিতে কমিশন উল্লেখ করে, স্থলবন্দরগুলোতে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সুতা কাউন্ট নির্ধারণের পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় অনেক সময় আমদানি ঘোষণার সঙ্গে পণ্যের গুণগত মান ও পরিমাণের অসঙ্গতি দেখা যায়। এতে একদিকে যেমন রাজস্ব ক্ষতি হয়, অন্যদিকে অসাধু আমদানিকারকরা সুবিধা নেয়।
কমিশন সুপারিশ করে, যখন পর্যন্ত সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর ও সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসগুলোতে সুতা কাউন্ট নির্ধারণের পর্যাপ্ত অবকাঠামো স্থাপন না হবে, ততদিন পর্যন্ত এসব স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির অনুমতি স্থগিত রাখা হোক।
সুতা বাজারে ভারতীয় দামের প্রভাব
চীন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং দেশের অভ্যন্তরেও যেসব সুতা উৎপাদিত হয়, সেগুলোর দাম প্রায় কাছাকাছি হলেও ভারত থেকে স্থলপথে আসা সুতার দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বিশেষ করে ভারতের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত সুতা কলকাতায় গুদামজাত করে সেখান থেকে ট্রাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
এই সস্তা সুতা মূলত পোশাকশিল্পে ব্যবহার হয়। কিন্তু এর ফলে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের উৎপাদিত সুতা ব্যবহারের হার কমে গেছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পখাতকে দুর্বল করে দিচ্ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ঘোষিত মূল্যের তুলনায় স্থলবন্দর দিয়ে আসা সুতার ঘোষিত মূল্য অনেক কম, যা প্রকৃতপক্ষে আন্ডার ইনভয়েসিং বা মূল্য কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকির আশঙ্কা বাড়ায়।
উৎপাদকদের দীর্ঘদিনের কষ্টের অবসান?
এনবিআরের প্রজ্ঞাপনে খুশি হয়েছেন দেশের সুতা উৎপাদনকারী মিল মালিকরা। বিটিএমএর একাধিক সদস্য বলেন, ‘‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম, ভারতীয় সুতা স্থলবন্দর দিয়ে কম দামে ঢুকে আমাদের বাজার ধ্বংস করে দিচ্ছে। এনবিআরের এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য স্বস্তির, কারণ এতে আমরা অন্তত সমান সুযোগে প্রতিযোগিতা করতে পারব।’’
তবে তাদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পাশাপাশি কাস্টমস চৌকসতা, নজরদারি, এবং অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সামগ্রিক শিল্পনীতিতে নতুন ধারা?
এই সিদ্ধান্ত দেশের শিল্পনীতির একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করছেন অর্থনীতি ও শিল্প বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতিবিদ ড. আবুল হোসেন বলেন, ‘‘দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় দেশীয় পণ্যের মান ও মূল্যের ভারসাম্যও জরুরি। স্থলপথ বন্ধ করে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শিল্পনীতিতে স্বচ্ছতা ও নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখতে হবে।’’
সরকারি পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আপাতত স্থলপথে আমদানি বন্ধ হলেও সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দর ব্যবহার করে সঠিকভাবে শুল্ক পরিশোধ করে আমদানি চালানো যাবে। তবে ভবিষ্যতে স্থলবন্দরে অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় মান নির্ধারণ পদ্ধতি চালু হলে পুনরায় এই সুবিধা চালু করা যেতে পারে।
এদিকে, এনবিআরের এই সিদ্ধান্তের ফলে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে সুতার আমদানি বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, ফলে এই দুই বন্দরের ওপর চাপ বাড়তে পারে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, দেশীয় শিল্প রক্ষার প্রয়োজনে এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ, এবং দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাবে দেশের সুতা ও বস্ত্র খাতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ