
ছবি: সংগৃহীত
দলিল রেজিস্ট্রেশন, তল্লাশি, নকল উত্তোলনসহ নানা প্রশাসনিক কার্যক্রমে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও ঘুষ আদায়ের অভিযোগে দেশের বিভিন্ন জেলার ৩৫টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একযোগে অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ অভিযানের লক্ষ্য হলো দলিল সম্পাদন প্রক্রিয়ায় ঘুষ-দুর্নীতি, দালালচক্রের দৌরাত্ম্য এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়মের শিকড় অনুসন্ধান ও প্রতিকার নিশ্চিত করা।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, বুধবার (১৬ এপ্রিল) সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট অভিযানে নামে। অভিযান শেষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দাখিল করবেন এবং পরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত জানানো হবে।
যেসব অফিসে অভিযান:
যেসব সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে—
খুলনা বিভাগ: খুলনা জেলা ও সদর, যশোর সদর, ঝিনাইদহ সদর, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, বাউফল (পটুয়াখালী), রাজাপুর (ঝালকাঠি)।
ঢাকা বিভাগ: ঢাকা জেলার আশুলিয়া ও মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ সদর, গাজীপুর সদর, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন, কিশোরগঞ্জের ইটনা, টাঙ্গাইলের কালিহাতী, শরীয়তপুর সদর, জামালপুরের সরিষাবাড়ী।
চট্টগ্রাম বিভাগ: কক্সবাজারের উখিয়া, চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, চন্দনাইশ উপজেলা, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, নোয়াখালী সদর।
রাজশাহী বিভাগ: বগুড়ার কাহালু, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, নাটোর, নওগাঁ সদর, পাবনা সদর।
রংপুর বিভাগ: রংপুর জেলা, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী, কুড়িগ্রাম জেলা।
সিলেট বিভাগ: সিলেটের গোয়াইনঘাট, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট।
ময়মনসিংহ বিভাগ: ময়মনসিংহের গৌরিপুর।
বরিশাল বিভাগ: বরিশাল সদর।
অন্যান্য: চিরিরবন্দর (দিনাজপুর), কুষ্টিয়া সদর।
দুর্নীতির প্রকৃতি ও অভিযোগ:
প্রায় প্রতিটি রেজিস্ট্রি অফিসে ভুক্তভোগীদের অভিন্ন অভিযোগ—দলিল রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নেই, প্রতিটি ধাপে ঘুষের দাবির মুখে পড়তে হয়, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে, আর দালালচক্রের মাধ্যমে ঘুষ দিলে দ্রুত কাজ হয়। শুধু ঘুষ নয়, দলিলের অনুলিপি (নকল) উত্তোলন, তথ্য যাচাই, জমির অবস্থান নির্ধারণ ও মালিকানা নিশ্চিতকরণে জটিলতা তৈরি করে ভোগান্তি বাড়ানো হয় পরিকল্পিতভাবে।
অনেক সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেবাগ্রহীতারা জানায়, সরকারি ফি প্রদানের পরও ‘চা-পান খরচ’ নামক অর্থ আদায় একটি প্রচলিত সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি কোনো কোনো অফিসে ফরম ও স্লিপ সরবরাহেও অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়।
দুদকের লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ:
দুদকের একাধিক টিম অভিযানে নথিপত্র যাচাই, সার্ভারে প্রবেশ করে কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু অফিসে দালালদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ চলছে।
দুদক জানিয়েছে, এই অভিযান একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ, যার মাধ্যমে রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে ঘুষ-দুর্নীতির শিকড় উৎখাত করা হবে। আগামীতে আরও বিস্তৃত অভিযান চালানো হবে, যেখানে অনুসন্ধান রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জনসচেতনতা ও সেবার স্বচ্ছতা:
দুদক কর্মকর্তারা বলেন, জনগণ যাতে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই এই অভিযান। ভবিষ্যতে রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে ডিজিটালাইজেশন এবং দালালমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকবে সংস্থাটি।
সারাদেশে রেজিস্ট্রি অফিসগুলোর কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়ানোর মাধ্যমে দুদক একদিকে যেমন দুর্নীতির জাল ছিন্ন করতে চাইছে, তেমনি নাগরিকদের ন্যায্য সেবা নিশ্চিত করতেও সংকল্পবদ্ধ। এই অভিযান এক নতুন বার্তা দিয়েছে—যে দলিল রেজিস্ট্রেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সেবায় অনিয়ম আর বরদাশত করা হবে না।
এই অভিযান শুধু একটি দিনের কার্যক্রম নয়, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান জাতীয় যুদ্ধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ