
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক পর নতুন করে কূটনৈতিক আলোচনার উদ্যোগ নিতে চলেছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। এই উপলক্ষে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ঢাকায় পৌঁছেছেন। বুধবার (১৬ এপ্রিল) দুপুর ১২টায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি।
বিশ্বস্ত কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান থেকে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ব্যাংকক হয়ে ঢাকায় আসেন আমনা বালুচ। ঢাকায় পৌঁছানোর পর তাকে নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরা অভ্যর্থনা জানান। সফরকালে তিনি রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করবেন।
দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশ-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ বা Foreign Office Consultation (FOC) শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ। কূটনীতিকরা বলছেন, ২০০৯ সালের পর এই প্রথমবার দুই দেশ এমন একটি বৈঠকে বসছে, যা দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন এক দিগন্তের সূচনা করতে পারে।
বৈঠকের দিন ও স্থান
বৃহস্পতিবার ১৭ এপ্রিল, এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন, অন্যদিকে পাকিস্তান পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন আমনা বালুচ।
কি নিয়ে আলোচনা হতে পারে?
যদিও বৈঠকের আলোচ্য বিষয় সরকারিভাবে জানানো হয়নি, তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু—যেমন বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষাবিনিময়, ভিসা সহজীকরণ, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াগত বিনিময় এবং সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
বিশেষ করে কূটনৈতিক যোগাযোগ পুনরায় সক্রিয় করা, অতীতের উত্তেজনাকর বিষয়াবলী পেছনে ফেলে সামনে এগোনোর রূপরেখা তৈরির দিকে নজর দিতে পারেন উভয় দেশের পররাষ্ট্র সচিবরা।
সৌজন্য সাক্ষাৎসূচি
বৈঠকের পাশাপাশি আমনা বালুচ সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, এসব সাক্ষাতে তিনি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যত সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবেন।
পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ের সফর আসন্ন
এই সফরের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করতে পারেন বলে জানা গেছে। তার সফরের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত দিনক্ষণ জানানো না হলেও, এটি হবে ২০১২ সালের পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। এই সফর বাস্তবায়িত হলে, তা হবে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃউজ্জীবনের একটি বড় পদক্ষেপ।
পটভূমি ও বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই উত্তপ্ত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধাপরাধ নিয়ে পাকিস্তানের বিতর্কিত অবস্থান, বাংলাদেশে উগ্রবাদ দমন ও নিরাপত্তা ইস্যুতে মতপার্থক্যসহ নানা কারণে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এসেছে। ভারত-চীন উত্তেজনা, আফগানিস্তান সংকট, ইসলামাবাদ-তেহরান সম্পর্ক, সৌদি নেতৃত্বাধীন সংগঠনের কার্যক্রম, এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য-যোগাযোগে ভারতের প্রতিযোগিতার মাঝে পাকিস্তান নতুন করে বাংলাদেশকে কাছে টানতে আগ্রহী হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের মত।
ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক মেলবন্ধনের ইঙ্গিত
বাংলাদেশ সরকারের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ইসলামাবাদ এবার একটি নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে। পাকিস্তান চায় পুরনো বিতর্কের বাইরে এসে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে। বিশেষ করে বাণিজ্য, চিকিৎসা, শিক্ষাক্ষেত্রে ভারত-বিকল্প সহযোগিতা গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী তারা।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখনো কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গীকার আসেনি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের এই সফর শুধুমাত্র কূটনৈতিক প্রোটোকলের অংশ নয়, বরং দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। বিগত দেড় দশকে জমে থাকা অবিশ্বাসের বরফ কতটা গলানো সম্ভব—তা নির্ভর করছে এই আলোচনার ফলাফলের ওপর।
আশা করা হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের ভাবনায় এই অঞ্চলের দুই গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় প্রবেশ করবে—সেটাই সময় বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ