
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবেশ, মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে—তা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশিরাই।
ওয়াশিংটনে মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এই মন্তব্য করেন। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কিছু সাম্প্রতিক আলোচিত ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরেন।
উগ্রবাদ ও বিক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন:
প্রেস কনফারেন্সে এক আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ট্যামি ব্রুসকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ইসলামপন্থী উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল, বিক্ষোভকারীরা প্রকাশ্যে ওসামা বিন লাদেনের ছবি বহন করেছিল, এবং মার্কিন প্রতীকের বিরুদ্ধে জনরোষ—যেমন কেএফসি ও কোকা কোলার দোকানে হামলা ও বয়কটের ডাক, ইত্যাদি দেখা গেছে। পাশাপাশি ইহুদিবিদ্বেষ এবং পশ্চিমবিরোধী মনোভাবেও উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়।
এই প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র কী অবস্থান নিচ্ছে—জানতে চাওয়া হলে, ট্যামি ব্রুস উত্তর দেন: “বাংলাদেশের কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো নিয়ে আমরা অতীতে বহুবার কথা বলেছি এবং আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি। এ ধরনের যেকোনো পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আমরা ধারাবাহিকভাবে নিজস্ব কূটনৈতিক পন্থা অনুসরণ করব।”
টিউলিপ সিদ্দিক প্রসঙ্গে উল্লেখ:
সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে যুক্তরাজ্যের এমপি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সম্পর্কেও প্রশ্ন আসে।
মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এই বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলেই ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন,“এটি অবশ্যই গুরুত্বের বিষয়। তবে এটি একটি অভ্যন্তরীণ বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ। আমরা মনে করি, এসব বিষয়ে দায়ী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
গণতন্ত্র, নির্বাচন ও জনগণের সিদ্ধান্ত:
সংবাদ সম্মেলনের শেষদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে ট্যামি ব্রুস জোর দিয়ে বলেন: “পরিশেষে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশি জনগণ নিজেরাই। যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে বরাবরই একটি নীতিগত অবস্থান নিয়েছে—যেখানে জনগণের মতামতই মুখ্য।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের জন্য অর্থবহ অনেকগুলো দিক রয়েছে, যার মধ্যে নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনশৃঙ্খলা এবং গণতন্ত্র অন্যতম। এসব বিষয়ই দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখবে।”
গণতন্ত্রের গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জ:
ট্যামি ব্রুস তার বক্তব্যে গণতন্ত্রের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “গণতন্ত্র শুধু একটি রাজনৈতিক কাঠামো নয়, এটি মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্ন। গত ২০-২৫ বছরে আমরা দেখেছি, কিছু ব্যক্তির কার্যক্রম অন্যদের জীবনকে বিপন্ন করেছে। সেসব পরিস্থিতি মোকাবিলাও গণতন্ত্রের অংশ।”
তিনি আরও বলেন, “আজকের দিনে পৃথিবীর অসংখ্য দেশের হাতে নানা বিকল্প রয়েছে, যেগুলো তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, সঠিক পথ বেছে নেওয়ার দায়িত্ব দেশটির জনগণের।”
কূটনৈতিক বার্তা স্পষ্ট:
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই বক্তব্যে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করার বার্তা রয়েছে, তেমনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার রক্ষা ও সুশাসনের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক নজরদারি অব্যাহত থাকবে—এই ইঙ্গিতও স্পষ্ট।
বিশেষ করে যখন বাংলাদেশে রাজনীতিতে মেরুকরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, এবং বিরোধী দলের প্রতি দমন-পীড়নের অভিযোগ বাড়ছে, তখন এমন বক্তব্য ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বার্তা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুসের বক্তব্য এক অর্থে বাংলাদেশের জন্য একটি কূটনৈতিক সতর্কবার্তা। গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত হয়েছে এই বক্তব্যে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বার্তাটি এসেছে, সেটি হলো: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণেরই। তবে সেই সিদ্ধান্ত যেন সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, সেদিকে নজর রাখছে বৈশ্বিক মহল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ