
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ, ঢাকায়। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের দীর্ঘকালীন স্থবিরতা কাটিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার পথে অগ্রসর হওয়ার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন ঢাকা সফরের প্রেক্ষাপটে আজকের এই বৈঠককে অনেকেই এক ধরনের ভূমিকা নির্ধারণী আলোচনার অংশ হিসেবে দেখছেন।
দীর্ঘ ২০ বছর পর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক
আজকের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের স্থলাভিষিক্ত জসিম উদ্দিন। পাকিস্তানের পক্ষে রয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ, যিনি বুধবার সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অনুবিভাগের মহাপরিচালক ইসরাত জাহান।
এই বৈঠক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শেষবার ২০০৪ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে এমন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই বৈঠকের প্রায় দুই দশক পর আজ আবারও দুই দেশ পরস্পরের সঙ্গে উঁচুপর্যায়ের কূটনৈতিক সংলাপে অংশ নিচ্ছে।
‘সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ’, বলছেন পররাষ্ট্র সচিব
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন জানান, “পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দীর্ঘদিন যাবৎ স্থবির ছিল। বর্তমানে আমরা একটি স্বাভাবিক আলাপ-আলোচনা শুরু করার চেষ্টা করছি। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আমাদের স্বার্থে করা হচ্ছে। এই বিষয়ে আজ আমরা বৈঠক করছি।”
তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে যা করছি, সেটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্বার্থে—যেমনটা আমরা অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে করে থাকি। এটি নিয়ে অন্য কোনো দেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।”
এই বক্তব্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ভারত বা অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কোনো ভুল ব্যাখ্যার আশঙ্কা থাকলেও, বাংলাদেশ তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির কাঠামো অনুযায়ী সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
সম্ভাব্য চুক্তি ও বাণিজ্য আলোচনা
এই বৈঠকের আরেকটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে। পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আজকের বৈঠক সেই সফরের প্রস্তুতিমূলক একটি ধাপ হিসেবে কাজ করছে।
জানা গেছে, ইসহাক দার সফরকালে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। বাণিজ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ ছাড়া পাকিস্তানের একটি উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলও ইসহাক দারের সফরে তাঁর সঙ্গে থাকবে। এই সফর দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্ব
দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাস নানা চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সম্পর্কের শীতলতা কাটিয়ে তুলনামূলক স্বাভাবিক কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু হলেও, নানা সময় রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিতর্কে সেই সম্পর্ক আবার অচলাবস্থার দিকে গেছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আঞ্চলিক সহযোগিতা, বাণিজ্যিক যোগাযোগ এবং মুসলিম বিশ্বের একাধিক আন্তর্জাতিক ফোরামে একসঙ্গে কাজ করার কারণে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা তৈরি হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক পরিসর আরও প্রসারিত করছে। আর সেই প্রেক্ষাপটেই পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের এ প্রচেষ্টা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আজকের বৈঠক নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। এতে কেবল দ্বিপক্ষীয় বিষয়েই নয়, বরং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যাবে। সম্পর্ক পুনর্গঠনের এই উদ্যোগ দুই দেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে, যদি পারস্পরিক আস্থা ও স্বচ্ছতায় এগিয়ে চলা সম্ভব হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ