
ছবি: সংগৃহীত
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প, যার সিংহভাগ অর্থায়ন করছে রাশিয়া। এই প্রকল্প ঘিরে নানা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা কাটিয়ে বাংলাদেশ সরকার দেড় বছর সময় বাড়িয়ে নিয়েছে ঋণ পরিশোধে। একই সঙ্গে ৫০ কোটি ডলারের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ঋণে বিলম্বজনিত কারণে সৃষ্ট ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের জরিমানাও মওকুফ করেছে রাশিয়া। এই ছাড় এবং সময়সীমা পরিবর্তন দেশের জন্য বড় এক স্বস্তির বার্তা হয়ে এসেছে।
মূলত রূপপুর প্রকল্পের ঋণের অর্থ পরিশোধ শুরুর সময় ছিল ২০২৭ সালের মার্চ। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ায় অর্থ পাঠানোও কঠিন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৯ সালের মার্চ পর্যন্ত সময় চেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। রাশিয়া যদিও দুই বছর নয়, দেড় বছর সময় দিয়েছে। ফলে এখন ২০২৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করবে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ইউরোপ উইংয়ের প্রধান ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি আলোচনার ভিত্তিতে এই ছাড় আদায় করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ এখনো বেশ কিছুটা বাকি। সেই বিবেচনায় আরও সময় চাওয়ার বিষয়েও রাশিয়া নীতিগতভাবে সম্মত।’
বিশেষ করে রাশিয়ার রোসাটম করপোরেশন ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে চুক্তি সংশোধনের বিষয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ওই বৈঠকে রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ উপস্থিত ছিলেন।
প্রকল্পের আর্থিক কাঠামো অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার, যা টাকায় দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাশিয়া ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে—যা প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়ন থাকছে বাকি ১০ শতাংশে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে প্রায় ৭ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় ৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের প্রক্রিয়া আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে ২০১৭ সালে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হলেও বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ঋণের অর্থছাড়ে দেরি হয়। বিশেষত, রাশিয়ার ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারে লেনদেন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ তাই এখন বিকল্প অর্থ পরিশোধ পদ্ধতি খুঁজছে। সংশ্লিষ্ট একটি ব্যাংকে ডলার সমপরিমাণ অর্থ জমা রাখা হচ্ছে, যা পরে রাশিয়ার কাছে স্থানান্তরের চেষ্টা চলছে।
আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা সংশোধিত ঋণ প্রটোকল অনুযায়ী, একটি বড় ধরনের ছাড় হলো ঋণ কিস্তি পরিশোধে এক মাস দেরি হলে আর কোনো জরিমানা দিতে হবে না। আগে এই প্রটোকলে বলা হয়েছিল, এক মাসের বিলম্ব হলে বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হবে। এই নিয়ম অনুসারে, ২০২২ সালের ১৫ মার্চ থেকে ২০২৫ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ঋণের কিস্তি না দেওয়ায় বাংলাদেশকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার জরিমানা দিতে হতো। রাশিয়া তা সম্পূর্ণ মওকুফ করেছে, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও আর্থিক সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
বর্তমানে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় অবস্থিত রূপপুর প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরেই মূল নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে রাশিয়ার রোসাটম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন, আর প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন করে গৃহীত সময়সূচি এবং জরিমানা মওকুফের সিদ্ধান্ত দেশের বৈদেশিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কিছুটা স্বস্তি আনবে। কারণ, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণপরিশোধের চাপ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে গেছে। সরকার বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থার কাছেই শর্ত শিথিল করার আবেদন করেছে। রূপপুর প্রকল্পের মতো বৃহৎ প্রকল্পে এমন ছাড় পাওয়া মানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতারও বহিঃপ্রকাশ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, রাশিয়ার এই আর্থিক ছাড় ও সময় বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সাফল্য এবং পরমাণু শক্তিনির্ভর জ্বালানি ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ