
ছবি: সংগৃহীত
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অভিবাসন নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের অংশ হিসেবে নতুন করে সাতটি দেশকে 'নিরাপদ দেশ' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনকারীদের জন্য কঠিন বাস্তবতা তৈরি করতে পারে। ইইউর নতুন এই নীতিমালার লক্ষ্য হচ্ছে, ‘নিরাপদ’ হিসেবে চিহ্নিত দেশগুলোর নাগরিকদের আশ্রয়প্রাপ্তির সম্ভাবনা কমিয়ে আনা এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করে অবৈধ অভিবাসীদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া গতিশীল করা।
তালিকায় বাংলাদেশসহ সাতটি দেশ
বুধবার ইউরোপীয় কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘নিরাপদ দেশ’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—বাংলাদেশ, কসোভো, কলম্বিয়া, মিসর, ভারত, মরক্কো ও তিউনিসিয়া। এই তালিকাকে কার্যকর করতে হলে ইইউ পার্লামেন্ট ও ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতি প্রয়োজন হবে। অনুমোদন পেলে, এসব দেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের সহজেই ফেরত পাঠানো যাবে এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ক্ষেত্রে ‘প্রথম দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য’ বলে গণ্য করার আইনি ভিত্তি পাবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনা
এই তালিকা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, ‘নিরাপদ’ দেশ ঘোষণার ফলে ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদনকারীদের ন্যায্য বিচারপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হবে। বিশেষ করে, এমন অনেক আবেদনকারী যারা রাজনৈতিক নিপীড়ন বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার—তাদের অভিযোগ দ্রুত খারিজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক চাপ এবং অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের প্রতিক্রিয়া
ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থানের সঙ্গে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইইউর ওপর চাপ বাড়ছে—অনিয়মিত অভিবাসনের প্রবাহ রোধ এবং অবৈধ অভিবাসীদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থাগুলো কঠোর করার জন্য। ইইউর অভিবাসন কমিশনার ম্যাগনাস ব্রুনার বলেন, “অনেক সদস্য রাষ্ট্র এখন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের জটের মধ্যে রয়েছে। এই জট নিরসনে একটি কার্যকর ও ত্বরান্বিত প্রক্রিয়া চালু করা জরুরি ছিল।”
প্রেক্ষাপট ও আগের উদ্যোগ
এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একেবারে নতুন উদ্যোগ নয়। এর আগে ২০১৫ সালে ইইউ একই ধরনের একটি তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সেই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায় তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে তীব্র বিতর্কের কারণে। তখন থেকে এই প্রক্রিয়া স্থগিত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে বেড়ে চলা অভিবাসন সংকট এবং রাজনৈতিক চাপ এই উদ্যোগ পুনরায় কার্যকর করার পথ সুগম করেছে।
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পৃথক তালিকা ও ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই তালিকাটি পরবর্তীকালে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন, সংশোধন বা সম্প্রসারণ করা হতে পারে। ভবিষ্যতে আরও দেশ এতে যুক্ত হতে পারে বা কোনো দেশকে বাদও দেওয়া হতে পারে, নির্দিষ্ট পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে। বর্তমানে যেসব দেশ থেকে তুলনামূলক বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী আসছে, মূলত সেই বিবেচনায় এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইইউর অনেক সদস্য রাষ্ট্র ইতোমধ্যে নিজেদের জাতীয় নীতিমালায় আলাদাভাবে নিরাপদ দেশের তালিকা প্রস্তুত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স মঙ্গোলিয়া, সার্বিয়া এবং কেপ ভার্দেকে নিরাপদ দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে, যদিও সেগুলো ইইউ-সামগ্রিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রভাব
বাংলাদেশকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ হচ্ছে, ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া বাংলাদেশিদের আবেদনগুলো এখন আরও কঠোর যাচাইয়ের মুখে পড়বে। আবেদনকারীদের এখন নিজ দেশে নিপীড়নের প্রমাণ খুব জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে, না হলে দ্রুত তাদের আবেদন নাকচ হয়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইইউতে প্রবেশকারীদের ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও সহজ হয়ে যাবে, যা ইউরোপে অবস্থানরত বহু বাংলাদেশি অভিবাসীর জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে।
ইইউর ‘নিরাপদ দেশ’ তালিকা রাজনৈতিক আশ্রয় ব্যবস্থার ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করছে। এই নীতিমালার ফলে যেমন ইউরোপে অভিবাসনপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তেমনি আশ্রয়প্রার্থীদের অধিকার রক্ষায় নতুন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বিষয়টি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ অভিবাসন অনেকাংশে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং বিশাল অভিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই নীতিগত পরিবর্তন তাই কেবল কূটনৈতিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ