
ছবি: সংগৃহীত
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা তুঙ্গে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অনির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তবে এই সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। সেই নির্বাচন কবে হবে, কীভাবে হবে—এখন সেটাই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
এতদিনেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রকাশ না করায় বিরোধী দল বিএনপি সহ অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বুধবার (১৬ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা স্পষ্টভাবে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছেন। কিন্তু তারা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা না পাওয়ায় বৈঠক শেষে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমরা বলেছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাই। এর পরে গেলে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা কোনো নির্দিষ্ট ডেডলাইন দেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।”
দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতা? প্রশ্ন উঠেছে কেন?
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক আঙিনায় আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে একটি প্রসঙ্গ—এই সরকার কি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়? এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে যখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সুনামগঞ্জ সফরে গিয়ে মন্তব্য করেন, “রাস্তা থেকে মানুষ বলছে, আপনারা আরও পাঁচ বছর থাকেন।” যদিও পরে তিনি বলেন, এটা তার ব্যক্তিগত বক্তব্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের মন্তব্য উল্লেখ করেছিলেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের বক্তব্য সরকারে দীর্ঘ মেয়াদি থাকার সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে পারে। তার ওপর যখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এখনো অনুপস্থিত, তখন জনমনে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, “সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ হলে আইনগত, রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক জটিলতা তৈরি হতে বাধ্য। অনির্বাচিত সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলে তার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, এবং সেটা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও।”
‘বিএনপিরও দায় আছে’ বলছেন বিশ্লেষকরা
অনেক বিশ্লেষক যদিও সরকারকে দায়ী করছেন নির্বাচনের সময় নির্ধারণে বিলম্বের জন্য, তবুও তারা বিএনপির ভেতরকার শৃঙ্খলার অভাব এবং নেতৃত্বের দুর্বলতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বিশিষ্ট লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “বিএনপি মনে করছে, তারা ভোট হলেই জিতে যাবে। সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই অনেক নেতাকর্মী চাঁদাবাজি, দখল এবং অপশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নানা অপরাধে যুক্ত হয়েছে।”
তিনি মনে করেন, এমন কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের মনে বিএনপির বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে। “মানুষ আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিকে আলাদা কিছু দেখতে পারছে না,” বলেন তিনি।
নির্বাচন ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদি সরকার? আইনি জটিলতা
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অনির্বাচিত। এ ধরনের সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার আইনি ভিত্তি কতটা শক্তিশালী—তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, “যেহেতু সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিধান নেই, এই সরকারকে নির্বাচিত সংসদে বৈধতা দিতে হবে। আর তা না হলে অনির্বাচিত সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
তাঁর মতে, অতীতে সামরিক শাসন যেমন সংবিধানে সংশোধনের মাধ্যমে বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল, এই সরকারও যদি তা চায়, তাহলে তা আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আর আদালতের আগের রায় অনুযায়ী, জাতীয় প্রয়োজনে হলেও অসাংবিধানিক কিছু বৈধ করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক চাপ এবং অংশীজনদের ভিন্ন অবস্থান
দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, সুশীল সমাজ, সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়—এই চারটি স্তম্ভকে অন্তর্বর্তী সরকারের অংশীদার হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই চার স্তম্ভের একটিরও আস্থা হারালে সরকারের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও, যদি দেখা যায় এই সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে যাচ্ছে, তাহলে কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফররত দুইজন মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপি, জামায়াত, এবং এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সক্রিয়ভাবে আগ্রহী।
বিএনপির কৌশল: সরকারকে চাপ, আলোচনার টেবিলে অন্য দলও
বিএনপি এখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় এবং এই দাবিতে তারা সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তারা ইতোমধ্যেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে এবং জুলাই চার্টারে স্বাক্ষর করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে রোডম্যাপ না পাওয়া পর্যন্ত তারা মাঠে সক্রিয় থাকবে বলে জানিয়েছে।
বিএনপি মনে করে, ফেব্রুয়ারিতে রোজা, এরপর কোরবানির ঈদ এবং জুনে বর্ষা মৌসুম—সব মিলিয়ে ডিসেম্বরের পর নির্বাচন কঠিন হবে। জামায়াতে ইসলামীও এ যুক্তির সঙ্গে একমত, তারা ফেব্রুয়ারির আগেই ভোট দাবি করেছে।
অন্যদিকে, এনসিপি সংস্কার শেষ না করে নির্বাচন চায় না। তাদের মতে, বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার রদবদল ছাড়া নির্বাচন হলে তা ফলপ্রসূ হবে না।
এ সরকারের মেয়াদ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে তা শুধু রাজনৈতিক নয়, আইনগত ও আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যার সৃষ্টি করবে। বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তা, বিভাজন এবং আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক। এখন দেখার বিষয়, সরকার সত্যিই নির্বাচনের পথে দ্রুত অগ্রসর হবে, নাকি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার গুঞ্জন আরও বাস্তবতায় রূপ নেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ