
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর ও বহুমাত্রিক করার লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দুই উপসহকারী সচিব—দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর নিকোল চুলিক এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক ব্যুরোর অ্যান্ড্রু হেরাপ। তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেন।
এই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কূটনীতিকরাও উপস্থিত ছিলেন। উভয় পক্ষের মধ্যে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় অত্যন্ত আন্তরিক ও ফলপ্রসূ পরিবেশে, যেখানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা, উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, জনগণ-পর্যায়ের সংযোগ, শ্রমমান উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সংকট এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা।
সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা
বৈঠকের শুরুতেই পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশ সরকারের সামগ্রিক সংস্কার উদ্যোগ তুলে ধরেন। তিনি জানান, বর্তমানে দেশে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, যারা বিভিন্ন খাতে কাঠামোগত ও নীতিগত পরিবর্তনের কাজ করছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, টেকসই উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এই সংস্কার উদ্যোগের প্রশংসা করে মার্কিন প্রতিনিধি দল জানায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের এই প্রচেষ্টার সঙ্গে রয়েছে এবং আগামীতেও এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দ্বিপাক্ষিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে বাস্তব আলোচনা
বৈঠকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় আন্তরিক এবং ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা যৌথভাবে এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
মার্কিন প্রতিনিধি দল এই প্রেক্ষিতে উল্লেখ করে, চলমান আলোচনার প্রেক্ষিতে নির্ধারিত ৯০ দিনের সময়সীমা খুবই সীমিত। তাই এই সময়ের মধ্যে স্পষ্ট, কার্যকর এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পররাষ্ট্রসচিব জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ এই ৯০ দিনের সময়সীমাকে 'স্থগিতকাল' হিসেবে দেখছে না বরং এটিকে সম্ভাবনার একটি জানালা হিসেবে গ্রহণ করছে, যার মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে গঠনমূলক সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
শ্রমমান, ইউএসএইড অর্থায়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা
বৈঠকে শ্রমমান উন্নয়নের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। পররাষ্ট্রসচিব আবারও বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং বলেন, শ্রমখাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে সরকার নীতিগত ও প্রশাসনিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
এ সময় পররাষ্ট্রসচিব সাম্প্রতিক সময়ে ইউএসএইড কর্তৃক স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে অর্থায়ন হ্রাসের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য মার্কিন প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (USDFC)-এ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সহযোগিতাও কামনা করেন। মার্কিন দল বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে এবং তাদের কংগ্রেশনাল অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেন।
রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা
বৈঠকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য ছিল রোহিঙ্গা সংকট। পররাষ্ট্রসচিব যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘদিন ধরে এই সংকটে বাংলাদেশকে সমর্থন জানানোয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বলেন, মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা ও রাখাইন রাজ্যের অস্থিতিশীলতা নতুন করে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের চাপ অব্যাহত রাখা দরকার। সেই প্রেক্ষাপটে আসন্ন নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য রোহিঙ্গা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সমর্থন প্রত্যাশা করেন পররাষ্ট্রসচিব।
মার্কিন প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। এই সংকটের টেকসই সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র তার কূটনৈতিক ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে আশ্বাস দেন তারা।
অংশীদারত্ব আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি
বৈঠকের শেষে উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক অংশীদারত্ব আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। তারা মত দেন যে, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং মানবাধিকার—এই সব খাতে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে হবে।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের এই আলোচনাকে একটি ‘গঠনমূলক সংলাপ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের কৌশলগত অংশীদারত্বের ভিত্তি রচনা করবে বলে উভয় পক্ষ আশা প্রকাশ করেছে। এখন দেখার বিষয়, এ সংলাপের ভিত্তিতে কত দ্রুত ও কতটা কার্যকরভাবে বাস্তব অগ্রগতি সাধিত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ