
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত আর্থিক ও ঐতিহাসিক বিষয়াদি অবশেষে আনুষ্ঠানিক আলোচনার টেবিলে উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) ঢাকার স্টেট গেস্ট হাউস পদ্মায় অনুষ্ঠিত হয় দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক—বাংলাদেশ-পাকিস্তান ফরেন অফিস কনসালটেশন (F.O.C)। এটি ছিল গত ১৫ বছরে এই ধরনের প্রথম দফতরপর্যায়ের বৈঠক। বৈঠকে বাংলাদেশ স্বাধীনতাপূর্ব পাওনা হিসেবে পাকিস্তানের কাছে ৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক দাবি উত্থাপন করে।
বাংলাদেশের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন এবং পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, নাগরিক বিষয়াদি, ইতিহাসভিত্তিক দাবি এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্যসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন।
তিনি জানান, বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার আগে জমে থাকা সম্পদের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের কাছে যে আর্থিক পাওনা রয়েছে তা পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—
-
১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের পর পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো কিন্তু ব্যবহৃত না হওয়া ২০০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা,
-
অব্যবহৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড,
-
সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য আর্থিক আমানত,
-
ব্যাংকে আটকে থাকা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের জমাকৃত অর্থ ইত্যাদি।
সব মিলিয়ে এই আর্থিক পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৪.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্বাধীনতার অর্ধশতক পরও ফেরত দেয়নি পাকিস্তান।
পররাষ্ট্রসচিব আরও জানান, “আমরা পাকিস্তানকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি—১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নারী নির্যাতনের দায় স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ করা এখনো বাকি রয়েছে। বাংলাদেশ এই দাবিতে অনড় এবং মনে করে, এটা কেবল কূটনৈতিক বিষয় নয়—এটি ইতিহাস, ন্যায়বিচার এবং নৈতিক দায়িত্বের প্রশ্ন।”
বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক ইস্যু হিসেবে আলোচিত হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের ফিরে নেওয়ার বিষয়টি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্বাধীনতার পর যারা বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে যারা পাকিস্তানে ফিরে যেতে আগ্রহী, তাদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের।
পররাষ্ট্রসচিব জানান, “স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬ হাজার ৯৪১ জন পাকিস্তানি নাগরিককে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তবে বর্তমানে দেশের ১৪টি জেলায় ছড়িয়ে থাকা ৭৯টি ক্যাম্পে এখনও প্রায় ৩ লাখ ২৪ হাজার ১৪৭ জন অবস্থান করছেন, যাদের অধিকাংশই পাকিস্তানে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি পাকিস্তানকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।”
বৈঠকের পর আরেকটি বড় কূটনৈতিক ঘোষণা আসে। জানানো হয়, পাকিস্তানের বর্তমান উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক ডার আগামী ২৭ ও ২৮ এপ্রিল ঢাকায় সরকারি সফরে আসছেন। ২০১২ সালের পর এই প্রথম কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন, যা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। ওই সফরে আরও উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ও চুক্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এই সফরের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আলাদাভাবে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে পরস্পর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় নিয়েও আলোচনা হয়।
এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া উইংয়ের মহাপরিচালক ইশরাত জাহান, ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার এবং ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের বর্তমান সরকার ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের উন্নয়নে নতুনভাবে আগ্রহী। তবে এই সম্পর্কের ভবিষ্যত নির্ভর করছে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক দায় স্বীকার, আর্থিক পাওনা পরিশোধ এবং রোহিঙ্গা সংকটসহ বাংলাদেশকে জড়ানো আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্নে তাদের অবস্থানের ওপর। সেই দিক থেকে এবারের এফওসি বৈঠককে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি সম্ভাবনাময় সূচনা হিসেবে দেখছেন কূটনৈতিক মহল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ