
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিনের জমে থাকা শীতল সম্পর্কের বরফ গলাতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আবারও কূটনৈতিক আলাপচারিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১৫ বছর পর অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনার মধ্যে দিয়ে উভয় দেশ পারস্পরিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক সম্ভাবনাকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের দিকে এগোচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আয়োজিত এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ। আলোচনার সময় দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের নানা দিক উঠে আসে, যার মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও পারস্পরিক বাধা অতিক্রমের উপায়।
দীর্ঘদিন পর মুখোমুখি আলোচনায় নতুন বার্তা
বৈঠকের শুরুতেই অধ্যাপক ইউনূস বলেন, "আমরা অনেক দিন ধরে একে অপরকে মিস করেছি। কারণ আমাদের সম্পর্ক ছিল হিমায়িত। এই জমে থাকা অবস্থান ভেঙে আমাদের সামনে এগোতে হবে। সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা থাকলেও সেগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করতে হবে।"
তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক শান্তি ও পারস্পরিক উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই লক্ষ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখন সময় এসেছে একসঙ্গে কাজ করার। ইউনূস জানান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বহুপাক্ষিক ও আঞ্চলিক ফোরাম যেমন সার্ক, ওআইসি এবং ডি-৮ এর মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতা বাড়াবে এবং ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে।
আমনা বালুচের প্রত্যাশা: হারানো সুযোগ না করতে
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ আলোচনার সময় অতীতের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, "আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তি শক্তিশালী করার সুযোগ আমরা বারবার হারাতে পারি না। এখন প্রয়োজন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া।"
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অনেক অমীমাংসিত সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক খাতে। "আমাদের একটি বিশাল আঞ্চলিক বাজার রয়েছে, যা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। আমাদের উচিত পারস্পরিক সুবিধার জন্য এই বাজারের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা," বলেন বালুচ।
তিনি আরও জোর দেন, দুই দেশের বেসরকারি খাতের মধ্যে নিয়মিত ব্যবসায়িক যোগাযোগ, বিটুবি (B2B) সংলাপ, এবং সব পর্যায়ের সফর বিনিময় ভবিষ্যতের সম্পর্ক মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উচ্চপর্যায়ের সফরের প্রস্তুতি, সম্পর্ক জোরদারে প্রত্যাশা
এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, আগামী এপ্রিলের শেষের দিকে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই সফরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার পরিধি আরও বাড়বে এবং সম্পর্ক দৃঢ় হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন আমনা বালুচ।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ এবং উভয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।
দীর্ঘ বিরতির পর সম্ভাবনার আলো
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের পর এই প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন পথ উন্মুক্ত করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে। নানা সময় রাজনৈতিক জটিলতা ও পারস্পরিক অনাস্থা এই সম্পর্কের পথকে রুদ্ধ করেছে।
কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দেশই এখন পারস্পরিক স্বার্থ ও আঞ্চলিক শান্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। ফলে, উভয় দেশের পক্ষ থেকেই অতীতের ভুলত্রুটি কাটিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশের কূটনৈতিক ভাষ্য অনুযায়ী, সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনার জন্য এখন উপযুক্ত সময়। একদিকে যখন বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও জ্বালানির সংকট বাড়ছে, তখন আঞ্চলিক একত্রীকরণ, বাণিজ্যিক সম্পর্কের সম্প্রসারণ, এবং কৌশলগত সহযোগিতা দু’দেশেরই উন্নয়নের পথ সুগম করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে যেমন আশাবাদের ঝলক রয়েছে, তেমনি পাকিস্তানও তাদের নতুন কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে হারানো সম্পর্ককে পুনরুদ্ধারের তাগিদ দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়—এই নতুন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ভবিষ্যতের বাস্তবতায় কতটা রূপ নিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ