
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া এবং প্রবাসীদের সমস্যা নিয়ে এক বিশদ পর্যালোচনায় বলেন, দেশের মধ্যেই কর্মী প্রেরণ ব্যবস্থার বড় অংশের সমস্যা সৃষ্টি হয়, যার পরিণতি বহন করতে হয় বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে। ফরেন সার্ভিস ডে উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে 'ফরেন সার্ভিস ডে' পালন করা হয়। দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরে দেশ-বিদেশে নিযুক্ত কূটনীতিক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বিশেষ বক্তব্য দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে রাষ্ট্রীয় কূটনীতির চ্যালেঞ্জ, প্রবাসীদের সেবা, রেমিটেন্স, রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
দেশের ভেতরেই জন্মায় অধিকাংশ সমস্যা
তৌহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে যে জটিলতা ও সমস্যার কথা প্রায়ই শোনা যায়, তার অন্তত ৮০ শতাংশেরই জন্ম হয় দেশীয় ব্যবস্থার মধ্যেই। বিদেশে পাঠানোর আগে যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, দক্ষতা ও শিক্ষা প্রয়োজন, তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হয় না। ফলে বিদেশে গিয়েই কর্মীরা সমস্যায় পড়েন এবং তখন সেই সমস্যাগুলোর সমাধানের দায়িত্ব এসে পড়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দূতাবাসগুলোর ওপর।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের দূতাবাসগুলো ইতিমধ্যেই জনবল, অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিকভাবে সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করে। এই অবস্থায় যদি দেশে সৃষ্ট সমস্যার ভার তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা কতটা দক্ষতার সঙ্গে প্রবাসীদের সেবা দিতে পারবে, তা সহজেই অনুমেয়।”
তৌহিদ হোসেনের মতে, বিদেশে পাঠানোর আগে যথাযথ প্রশিক্ষণ, আইনগত সচেতনতা এবং ভাষা শিক্ষা প্রদান করা গেলে প্রবাসীদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। এর ফলে দূতাবাসগুলোর ওপর চাপও কমে আসবে এবং তারা আরও দক্ষভাবে অন্যান্য কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
প্রবাসীদের সেবা দিতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, “প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এক কোটি প্রবাসী নিরলসভাবে বিদেশে কাজ করছেন এবং নিয়মিতভাবে দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। আমাদের দূতাবাসগুলোর দায়িত্ব হলো—তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা এবং তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা।”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “দূতাবাসগুলোর নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থাকলেও তা যেন কখনো প্রবাসীদের সেবা প্রদানে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। একজন বাংলাদেশি নাগরিক বিপদে পড়লে তার সবার আগে বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকার রয়েছে। সে অধিকার যেন কখনো ব্যাহত না হয়।”
রেমিটেন্স ও অর্থনীতিতে দূতাবাসের অবদান
রেমিটেন্স প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা যদি ১৯৮০-এর দশকে ফিরে তাকাই, তখন আমাদের বার্ষিক রপ্তানি আয় ছিল মাত্র এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো। এই অগ্রগতিতে দূতাবাসগুলোরও নিরব ভূমিকা রয়েছে। তারা শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, সমস্যা সমাধান এবং নতুন চুক্তির মাধ্যমে রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।”
তৌহিদ হোসেন এ সময় জানান, প্রবাসীদের সমস্যার দ্রুত সমাধান, বিশেষত অভিবাসন–সংক্রান্ত জটিলতা, বৈধতার সংকট, পাসপোর্ট ও কনস্যুলার সেবা—এই বিষয়গুলো দূতাবাসের অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে থাকা উচিত।
রোহিঙ্গা সংকট ও কূটনৈতিক জটিলতা
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “এই সংকট এখনো বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বড় মানবিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে আরাকান আর্মি এই ইস্যুতে এক বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। আমরা না পারছি তাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে, না পারছি তাদের এড়িয়ে চলতে।”
এখানে তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, “যেহেতু মিয়ানমারে একটি স্বীকৃত ও স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামো নেই, তাই সেখানে আমাদের জন্য কোনও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি কার্যকর রাখা দুরূহ হয়ে পড়ছে। আরাকান আর্মির আধিপত্য শুধু নিরাপত্তার হুমকি নয়, বরং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই জটিল করে তুলেছে।”
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফরেন সার্ভিস
আলোচনার এক পর্যায়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা স্মরণ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফরেন সার্ভিসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ শুরু করেছিল। তখন মাত্র ৬৫ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন, যারা সীমিত সম্পদে বিশাল কূটনৈতিক যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।”
এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আজকের তরুণ কূটনীতিকদের সেই চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতে হবে। শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্ব নয়, জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব করাও পররাষ্ট্র সেবার অন্যতম দায়িত্ব।”
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার এখন কেবল রাষ্ট্রীয় স্তরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করাও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কর্মীদের বৈধ ও প্রস্তুতিপূর্ণ প্রেরণ, প্রবাসীদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দূতাবাসের জবাবদিহিমূলক কার্যক্রমই ভবিষ্যতের পররাষ্ট্র কূটনীতির মূল চালিকাশক্তি হবে বলেই মত দেন তিনি।
এই উপলব্ধি এবং অঙ্গীকার বাস্তবায়নেই গড়ে উঠতে পারে এক মানবিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা দেশকে শুধু কূটনৈতিকভাবে নয়, অর্থনৈতিকভাবেও আরও এগিয়ে নিতে পারবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ