
ছবি: সংগৃহীত
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ও কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের একটি সংঘটিত হয় রাজধানীর পিলখানায়, তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদর দপ্তরে। বিদ্রোহের নামে সংঘটিত এ বর্বর ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ও ১৭ জন বেসামরিক নাগরিক নৃশংসভাবে নিহত হন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর, এখন এই ঘটনার পেছনের প্রকৃত রহস্য উন্মোচন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে সরকারের নির্দেশে গঠিত হয়েছে একটি পূর্ণ স্বাধীন তদন্ত কমিশন, যা ইতোমধ্যেই সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে।
গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন তথ্য আহ্বান
জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন সম্প্রতি একটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এবং বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—যাদের কাছে পিলখানা হত্যাযজ্ঞ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা সাক্ষ্য রয়েছে, তারা যেন তা কমিশনকে সরবরাহ করেন। এই তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যমে কমিশন প্রকৃত ঘটনা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ধারা ও সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নির্ধারণে সক্ষম হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
তথ্য প্রদানকারীরা কমিশনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট www.bdr-commission.org, ইমেইল ([email protected]), হটলাইন (০১৭৬৯-৬০০২৮১, সকাল ৯টা–বিকাল ৫টা) কিংবা সরাসরি উপস্থিত হয়ে অথবা ডাকযোগ ও কুরিয়ারের মাধ্যমেও তাদের তথ্য পাঠাতে পারবেন।
কমিশনের ঠিকানা হলো—বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (বিআরআইসিএম), নতুন ভবন (৭ম তলা), ড. কুদরত-এ-খুদা সড়ক, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫।
বিদেশে বসবাসরত ব্যক্তিরা চাইলে কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক তথ্য প্রদান করতে পারবেন।
গোপনীয়তা রক্ষা এবং তথ্য জমা দেওয়ার ধরন
বিজ্ঞপ্তিতে আশ্বস্ত করা হয়েছে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখা হবে। তথ্যদাতা ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে তার নাম, ফোন নম্বর, ইমেইল ও ঠিকানা সাবমিট করবেন এবং তথ্যের ধরন নির্বাচন করবেন। তথ্যের ধরনগুলো হলো:
শহিদ পরিবারের সদস্যদের বিবৃতি
প্রত্যক্ষদর্শী বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষ্য
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবেদন, ছবি, ভিডিও, অডিও
মোবাইল কল রেকর্ড, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ইত্যাদি।
তদন্তের ব্যাপক লক্ষ্য ও বিস্তৃতি
কমিশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পিলখানার হত্যাযজ্ঞে জড়িত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা, যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে বা সহায়তা করেছে, প্রমাণ নষ্ট করেছে, কিংবা এসব ঘটনা প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। একইসাথে সরকারি বিভাগ, সংস্থা, সংগঠন বা ব্যক্তির দায়িত্বহীনতা থাকলে তাও চিহ্নিত করা হবে।
এই কমিশন “কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট ১৯৫৬” এর আওতায় গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর গঠিত হয়। এতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানকে সভাপতি করা হয়। তদন্তের ক্ষেত্রে কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে, কোনো প্রকার প্রভাব ও চাপমুক্ত অবস্থায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিচারিক প্রক্রিয়ার বিস্তৃত পর্যালোচনা
পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পর ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়। সবচেয়ে বড় হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ৮৫০ জনকে। বিচারিক আদালত ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন—১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২৭৮ জনকে খালাস দেওয়া হয়।
পরে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় দেন, যা ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশ হয়। হাইকোর্ট ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন এবং ২২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন; ২৮৩ জনকে খালাস দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন।
এখনও ২২৬ জন আসামি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছেন। অন্যদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও তথ্য সংগ্রহ
কমিশন জানিয়েছে, তারা ইতোমধ্যে কিছু বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এই বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংরক্ষিত বহু উপাত্ত কমিশনের হাতে এসেছে এবং তা পর্যালোচনার প্রক্রিয়াও চলছে।
ইতিহাসের কলঙ্ক মোচনের প্রত্যয়
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত পিলখানার হত্যাযজ্ঞ ছিল কেবল সেনাবাহিনীর নয়, পুরো জাতির হৃদয়ে এক স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন। বহু বছর পেরিয়ে গেলেও এই ঘটনার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন হয়নি বলে বহুজনের বিশ্বাস। জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন সেই বিশ্বাস ও প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই এবার নতুন করে তথ্য আহ্বানের মাধ্যমে দেশবাসীর দ্বারে দ্বারে পৌঁছাতে চায়। এই তদন্ত শুধু বিচারপ্রাপ্তি নয়, ইতিহাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠারও একটি সুযোগ—যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো এমন বর্বরতার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ