ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ ১৫ বছর পর পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক গুরুত্ব বহন করছে। বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকটিকে উভয় দেশই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের দিকচিহ্ন হিসেবে দেখছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিস্তারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ফলপ্রসূ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার নানা ক্ষেত্র নিয়ে গভীর আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ। দীর্ঘ সময় পর এই ধরনের উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় বসা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আলোচনায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, নিরাপত্তা ও সংযোগমূলক ইস্যুতে দুই পক্ষই খোলামেলা ও গঠনমূলক মতবিনিময় করেছে।
বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে করাচি ও চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি নৌযান চলাচল শুরুর সম্ভাবনা। উভয় দেশই এটিকে আন্তঃদেশীয় সংযোগ বৃদ্ধির একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে। সংযোগকে অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরে দুই দেশের মধ্যে আকাশপথে সরাসরি যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের ওপরও জোর দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকা ফ্লাইট চলাচল পুনরায় শুরু করার সম্ভাবনা উভয় পক্ষই ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে।
উভয় দেশ ভ্রমণ ও ভিসা সহজীকরণ বিষয়ে সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের পদক্ষেপ আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হলে ব্যবসা, শিক্ষা ও পর্যটনে যোগাযোগ আরও মজবুত হবে।
ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনগণের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষার ওপর জোর
দ্বিপক্ষীয় আলোচনা প্রসঙ্গে পাকিস্তান বলেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শুধুই রাষ্ট্রীয় স্তরের নয়, বরং দুই দেশের রয়েছে অভিন্ন ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বন্ধন এবং মানুষের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা। এসব বিষয় ভবিষ্যতের সম্পর্ক জোরদারে ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে বলেও বৈঠকে আলোচনা হয়।
সার্ক পুনরুজ্জীবন ও আঞ্চলিক সংহতি
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে মত দিয়েছে। সার্কের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়।
এছাড়া পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য আসেনি, তবে সার্বিক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গুরুত্ব দুই পক্ষই অনুধাবন করেছে।
গাজা সংকট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা
বৈঠকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে। দুই দেশ গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং নিন্দা জানায়। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সংকট সমাধানে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানায়।
শিক্ষা, কৃষি ও কারিগরি প্রশিক্ষণ
পাকিস্তান বৈঠকে তাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ মৎস্য ও সামুদ্রিক বিষয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার আগ্রহ প্রকাশ করে। পাকিস্তানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির প্রস্তাবের জন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং শিক্ষা খাতে আরও গভীর ও কাঠামোগত সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
ক্রীড়া, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতিতে সহযোগিতার পরিকল্পনা
দুই দেশের মধ্যে ক্রীড়া, গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। এইসব খাতে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ও বিনিময় বাড়লে সাধারণ জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সৌহার্দ্য বাড়বে বলেও মত দেন কর্মকর্তারা।
ভবিষ্যৎ পথচলা
এ বৈঠক শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ভবিষ্যতের একটি রূপরেখা বলে মনে করছে পাকিস্তান। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘এই বৈঠক ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিয়েছে—যেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কেবল পুনরুজ্জীবিত হবে না, বরং আরও গঠনমূলক এবং বহুমুখী রূপে বিকশিত হবে।’
উল্লেখ্য, বিগত বছরগুলোতে নানা রাজনৈতিক জটিলতা, ইতিহাস ও কূটনৈতিক অচলাবস্থার কারণে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে উচ্চপর্যায়ে নিউইয়র্ক, কায়রো, সামোয়া ও জেদ্দায় যেসব বৈঠক হয়েছে, সেগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। এসব উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বরফ গলাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ বলছে।
এই নতুন গতিপথ দুই দেশের মধ্যে একটি ভবিষ্যতমুখী, পারস্পরিক সম্মানভিত্তিক এবং সহনশীল সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে বলে কূটনীতিক মহলের প্রত্যাশা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



