
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেছেন, বিশ্বের ইতিহাসে বহু শত্রু পরস্পরের মধ্যে মিত্রতা প্রতিষ্ঠা করেছে, আর বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি তেমনি একটি উদাহরণ হতে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে চলমান বিতর্ক এবং প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তিনি এই মন্তব্য করেন। আজাদ মজুমদার বলেন, "বিশ্বে পূর্ব শত্রুদের মিত্রে পরিণত হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেমন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড শতাব্দী ধরে অসংখ্য যুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাত মিলিয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানও একই যুদ্ধে বোমাবর্ষণের পর মিত্রদেশে পরিণত হয়।"
এখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে, বিশেষত পাকিস্তানপন্থি পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উঠছে। এই প্রশ্নের উত্তরে আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, “এমন কিছু মানুষ সবসময় থাকবে যারা বাংলাদেশের স্বাধীন পরিচয়ে খুব কমই বিশ্বাস করবে, কিন্তু আমাদের জবাব স্পষ্ট ছিল। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবসময় বাংলাদেশপন্থি হবে, যা আমাদের নিজস্ব স্বার্থে পরিচালিত হবে।”
আবুল কালাম আজাদ মজুমদার আরও বলেন, "একটি স্বাধীন জাতির পররাষ্ট্রনীতি কখনও এমন হতে পারে না, যেখানে এক প্রতিবেশীকে খুশি রাখতে অন্য প্রতিবেশীকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়।" তিনি পাকিস্তানের সফররত পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সঙ্গে আলোচনার মধ্যে এই বিষয়টি তুলে ধরেন। বালুচ বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নতির জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আজাদ মজুমদার জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকিস্তান কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। "পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যা এবং নৃশংসতার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি," বলেন তিনি। পাকিস্তানের সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন যে, ক্ষমা চাওয়াটা একটি সদিচ্ছা এবং উদারতার প্রতীক হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্র এবং পররাষ্ট্র দপ্তর বারবার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে, ফলে এখনো এই বিষয়টি আলোচনায় আনা হয়নি।
আজাদ মজুমদার বলেন, অতীতে দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যা ঘটুক না কেন, বর্তমানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হবে বাংলাদেশপন্থি, যা শুধুমাত্র দেশের স্বার্থে পরিচালিত হবে। তিনি আরও বলেন, অতীতে পাকিস্তান থেকে বিভক্তির বিষয়টি ভুলে গিয়ে দেশীয় সম্পদের বিভাজন নিয়ে আলোচনা না করাই ছিল শাসকদের ভুল। "১৯৭৪ সালের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা," জানান তিনি।
এছাড়া, ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থা থেকে অনুদান আসলেও পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান-এর লাহোর শাখায় ওই অর্থ স্থানান্তরিত হওয়ার পর তা বাংলাদেশের কাছে ফিরে আসেনি। বাংলাদেশের দাবি, পাকিস্তানকে আরও প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন। অতীতে পাকিস্তান তাদের এক লাখ ২৫ হাজার নাগরিক ফিরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু এখনো প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার পাকিস্তানি বাংলাদেশের ১৪টি জেলার ৭৯টি শিবিরে আটকা পড়ে রয়েছে।
আজাদ মজুমদার বলেন, এসব সমস্যা দেশের সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করছে, তবে সমস্যাগুলোর সমাধান আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব। "এটি সত্যিই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে আবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে," বলেন তিনি।
উল্লেখযোগ্যভাবে, গত ডিসেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে এক বৈঠকে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সঙ্গে বৈঠকে ইউনূস এই আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন এবং এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
আজাদ মজুমদার আরও বলেন, "এখন হয়তো সময় এসেছে, অতীতের ইস্যুগুলো সমাধান করার এবং বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতির জন্য এক সঙ্গে কাজ করার।"
বাংলাবার্তা/এমএইচ